তাপদাহে পুড়ছে দেশ : জীবননগরে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু মেহেরপুরে ৬ ছাত্রী অসুস্থ

 

স্টাফ রিপোর্টার: চৈত্রের বিদায়কালে খরতাপে পুড়ছে সারাদেশ। গতকালও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এরপরও আবহাওয়া অধিদফতর যে জেলাগুলোর ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, তার মধ্যে চুয়াডাঙ্গার নাম নেই। অথচ আবহাওয়া অধিদফতরই দেশের এবং চলতি মরসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গতকাল চুয়াডাঙ্গাতেই রেকর্ড করা হয়।

রোদ-গরমের তীব্রতায় জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। গত তিনদিনে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে হিটস্ট্রোকে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে গতকাল সোমবার বিপরীত চিত্র ছিলো ঝিনাইদহে। গত দু দিন ধরে ঝিনাইদহে কুয়াশা পড়ছে। গতকালও সকাল ৭টা পর্যন্ত ওই এলাকায় সূর্যের মুখ দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক। মেহেরপুরে বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে চুয়াডাঙ্গার বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। রাস্তায় লোকসমাগমও কমেছে।

চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করায় জনজীবন থমকে গেছে। তাপমাত্রার সাথে গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় হাঁসফাঁস অবস্থা। গতকাল সোমবার চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ চোখে পড়ে। শিক্ষার্থীদের তুলনায় বৈদ্যুতিক পাখা এমনিতেই কম, তার ওপর অর্ধেক বিকল। প্রচণ্ড তাপদহের কারণে বিদ্যালয় দুটিতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গেছে। আবার ঘন ঘন বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে সেগুলোও ঠিকমত চলে না। ছাত্রীরা এ সময় অর্ধদিবস বিদ্যালয় খুলে রাখার দাবি করে। গরমের কারণে খেটে খাওয়া মানুষগুলো বিপাকে পড়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হচ্ছে না। চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রত্না খাতুনসহ কয়েকজন জানায়, তাদের ক্লাসরুমের ছয়টি ফ্যানের মধ্যে ৩টি অকেজো হয়ে রয়েছে। একই অবস্থা তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণির ক্লাসগুলোতে। এছাড়া বিদ্যালয়ে প্রায় ২ হাজার ২০০ ছাত্রীর জন্য মাত্র ১টি টিউবওয়েল চালু রয়েছে। এতে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ওয়াশরুমগুলোতে রয়েছে পানির সঙ্কট। এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মহসীন আলী বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটের স্বীকার করে জানান, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরকে পানি সঙ্কটের কথা জানানো হয়েছে। বিদ্যালয়ের চারটির মধ্যে ৩টি টিউবওয়েল চালু রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে গতকাল দুপুরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে, মোবাইলফোন ও ল্যান্ড টেলিফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনি মোহন বিশ্বাস জানান, বিদ্যালয়ে ২ হাজার ৩৫৭ জন ছাত্রের জন্য মাত্র ৩টি টিউবওয়েল থাকলেও আরো টিউবওয়েল প্রয়োজন রয়েছে। টিউবওয়েল চাহিদার কথা পৌর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু জানান, ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পানি সঙ্কটের কথা জেনে অফিস থেকে লোক পাঠিয়েছিলাম। তবে টিউবয়েল নয়, ডিপটিউবওয়েল প্রয়োজন। বিষয়টি কীভাবে করা যায় ভেবে দেখা হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরে চুয়াডাঙ্গা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহেদুল ইসলাম  জানান, আরো দুইদিন তাপদাহ অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো দিনাজপুরে ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় গতকাল তাপমাত্রা ছিলো ৩৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গতকাল রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি, ফরিদপুরে ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি, কুমারখালীতে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি, সাতক্ষীরায় ৩৯ ডিগ্রি, টাঙ্গাইলে ৩৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি, বগুড়ায় ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি ও রংপুরে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিলো। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আরও কয়েকদিন ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি এটি বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে আগামী বৃহস্পতিবার পয়লা বোশেখেও খরতাপে পুড়তে পারে প্রায় সারাদেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এ মরসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এছাড়া চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে ১-২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে একটি।

আবহাওয়া অফিস জানায়, পাবনা, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ও রংপুর বিভাগ এবং রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে মৃদু  থেকে  মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এছাড়া চলতি মাসে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহের পাশাপাশি ১-২টি মৃদু বা মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল সকালে ঝিনাইদহে হালকা কুয়াশা পড়তে দেখা যায়। শেষ চৈত্রে এ কুয়াশাকে লোকে বিরল বলে মন্তব্য করে। গত দুদিন ধরে এ কুয়াশা পড়ছে। আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগরের উথলীতে তীব্র তাপদাহে হিটস্ট্রোকে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার উথলী গ্রামের রহিমা খাতুন (৬৫) সোমবার দুপুরে হিটষ্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে উপজেলার গত ৩ দিনে হিট স্ট্রেকে আক্রান্ত হয়ে ২ জনের মৃত্যু হলো। গত ৫ দিনে জীবননগরে তাপমাত্রা বাড়ছেই। প্রচণ্ড দাবদাহ, আগুনের মতো উত্তপ্ত বাতাস আর ভ্যাপসা গরমে কাহিল হয়ে পড়েছে জনজীবন। ফ্যানের বাতাসেও স্বস্তি মিলছে না। ঘরে-বাইরে সর্বত্র অসহনীয় অবস্থা। যেন আগুনের ফুলকির ন্যায় তাপপ্রবাহের কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এছাড়া তাপদাহের কারনে পুড়ছে ফসলের ক্ষেত।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসসূত্রে জানা গেছে, সোমবার দেশের সর্ব্বোচ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি মরসুমের সর্ব্বোচ তাপমাত্রা। গত ৫ দিন ধরে উপজেলায় তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তীব্র তাপদাহের কারণে প্রচণ্ড রোদের পাশাপাশি আগুনের মতো উত্তপ্ত বাতাস আর ভ্যাপসা গরমের তীব্রতা ও রোদের প্রখরতায় মাঠে, পথে-ঘাটের মানুষের দরদর করে ঘামতে দেখা গেছে। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েন অনেকেই। দৈনন্দিন কাজকর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং উপজেলায় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সেই সাথে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুপাখিও কাবু হয়ে পড়েছে। গরমের কারণে রোদের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে শহরের রাস্তা-ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না।

কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী মোছা. মুর্শিদা খাতুন তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার স্কুল চলাকালীন ৪টার দিকে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়লে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়িতে পাঠান। মুর্শিদা খাতুন কুনিয়া চাঁদপুরের মফেজ উদ্দীনের মেয়ে।

গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে জেলার গাংনী উপজেলায় ক্লাস চলাকালে ছয়জন ছাত্রী অসুস্থ হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। অসুস্থ শিক্ষার্থীরা হলো- নবম শ্রেণির ইয়াসমিন খাতুন (১৫), কেয়া খাতুন (১৫), সপ্তম শ্রেণির সুকতারা খাতুন (১৩), এশা খাতুন (১৩), আলোকা খাতুন (১৪) ও রাবেয়া খাতুন (১৩)। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোমানুল হক জানান, অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার এমকে রেজা জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এতে চিন্তার কিছু নেই।