স্টাফ রিপোর্টার: নিরীক্ষাব্যবস্থার চরম দুর্বলতা, বাজেট স্বল্পতা, ঝুঁকিপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার, দক্ষ জনবলের অভাব এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সম্যক জ্ঞান না থাকাসহ নানা রকম সংকটে ব্যাংকিং খাতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৩ শতাংশ ব্যাংকে কোনো আইটি নিরীক্ষক নেই। ৩০ শতাংশ ব্যাংকে নেই আইটি নিরাপত্তা কর্মকর্তা। আইটি অডিটরদের (নিরীক্ষক) মধ্যে ২৬ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ডিগ্রি বা পড়াশোনা নেই। আইটির নিরীক্ষাও করানো হয় তথ্যপ্রযুক্তির সাথে যুক্ত নন এমন লোকজন দিয়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তির ত্রুটিগুলো ধরা পড়ছে না। এতে তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তায় একটি বড় শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতের আইটি নিরাপত্তার বিষয়ে বিআইবিএমের গবেষণায় উঠে আসা তথ্য প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে গবেষণাটির সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান আলম বলেন, আইটি খাতে যেসব জনশক্তি তৈরি হচ্ছে, তাদের দেশে রাখা যাচ্ছে না। উচ্চ বেতনে তারা বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যা আন্তর্জাতিক মানের, এ নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে অভ্যন্তরীণ দক্ষ জনশক্তির বড় ঘাটতি রয়েছে। আপডেটেট টেকনোলজির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে আইটি বিশেষজ্ঞদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সার্বিক আর্থিক খাতে প্রযুক্তির কোথায় ঘাটতি আছে, তা খুঁজে বের করা দরকার। এই গবেষক আরো বলেন, আইটি সংক্রান্ত খরচ করতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (পরিচালনা পর্যদের) অনীহা রয়েছে। আইটি বিভাগের কোনো চাহিদা থাকলে তারা তা বুঝতে পারেন না, দিতেও চান না। আরেকটি হচ্ছে, যারা গ্রাহক, তাদের সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। গ্রাহকরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, সেই বিষয়ে তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। এ কারণে চোরের দল সেই সুযোগ নিচ্ছে।
গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কারণে সাইবারঝুঁকির বিষয়টি এখন সামনে এসেছে। এটি তথ্যপ্রযুক্তিগত দুর্বলতার একটি দিক মাত্র। এর বাইরে ডেটা সেন্টার বা তথ্যভাণ্ডারের একটি বড় ঝুঁকি রয়ে গেছে। যদি তথ্যভাণ্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কিন্তু একটি ব্যাংকের সব শেষ হয়ে যাবে। দেশে যেভাবে দ্রুত হারে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতের জন্য সেটা বড় মাথাব্যথার কারণ। এছাড়া আইটির নিরীক্ষা করানো হয় তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত নন এমন লোকজন দিয়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তির ত্রুটিগুলো ধরা পড়ছে না। তাই সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডেটা ব্যাংক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করেছে হ্যাকাররা। এর ঠিক পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি ইউসিবিএল, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং দি সিটি ব্যাংকের ৪টি বুথে এটিএম মেশিনে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে ২৫ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে।
বিআইবিএমের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে যতো ব্যাংক আছে, তার মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ ব্যাংকের ডেটা সেন্টার পরিচালনার জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত লোক রয়েছেন। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৪৪ শতাংশ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) ওপর কর্মীদের জন্য অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের আয়োজন করে না। এমআইএস বিষয়ক স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন তৈরিতে ‘বিজনেস ইন্টেলিজেন্স’ নামের উচ্চ প্রযুক্তির সফটওয়্যার ব্যবহার করে মাত্র ১০ শতাংশ ব্যাংক।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তির (আইটি) ব্যবহার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। তখন অবশ্য প্রযুক্তি এত ভালো ছিল না, অর্থও ছিল না। ছোট ছোট সফটওয়্যার ব্যবহার করা হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটির ব্যবহার বেশি ছিল না। ব্যাংকিং খাতে আইটির বড় ধরনের ব্যবহার শুরু হয়েছে মূলত সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সময়ে। এই সময়ে প্রযুক্তিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। বিআইবিএম গবেষণা করে দেখেছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে প্রযুক্তিতে। প্রায় ৫ হাজার আইটি পেশাজীবী রয়েছেন এই খাতে। ২০০৭ সালে ৩৭ শতাংশ ব্যাংক শাখা ছিল স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির আওতায় বা অটোমেটেড। এখন ৯০ শতাংশ শাখা অটোমেটেড।
গবেষণার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইটির ব্যবহারের দিকটি যতটা এগিয়েছে, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সেভাবে এগোয়নি। দেশের ব্যাংকিং খাতে এখন আইটির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের অভাব। এর পাশাপাশি সচেতনতার অভাব।
গবেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে যারা আইটি খাত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের আইটি বিষয়ে কোনো ডিগ্রি বা পড়াশোনা নেই। শুরুতে যখন আইটির লোকজন পাওয়া যেত না, তখনকার জন্য এই ব্যবস্থা মেনে নেয়া যায়। এখন কিন্তু আগের সেই অবস্থা নেই। এ খাতে এখন অনেক দক্ষ লোক তৈরি হয়েছে। তাই এখন ব্যাংকিং খাতের আইটির দায়িত্ব এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। আইটি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রযুক্তির কিছু ঝুঁকি সব সময়ই থাকবে। প্রতিনিয়তই প্রযুক্তি বদলাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। তাই ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হলে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। একটা সময় ছিল, যখন আইটির জন্য নিরাপত্তা শাখা বলতে কিছুই ছিল না। ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে খুব উদাসীন ছিলো।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিআইবিএমের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে আইটি নিরাপত্তায় মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয়েছে। নানা রকম সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পর ২০১৪ সালে এসে এই খাতে বরাদ্দ বেড়ে ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, ব্যাংকিং খাতে মোট যে ব্যয়, তার মাত্র ৪ শতাংশ খরচ করা হয় আইটি নিরাপত্তায়। আইটি প্রশিক্ষণে খরচ করা হয়েছে ২ শতাংশের কম অর্থ। আর আইটি নিরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে খরচ করা হয়েছে ১ শতাংশ।
মো. মাহবুবুর রহমান আলম আরো বলেন, ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তির বড় সমস্যা হচ্ছে, সঠিক লোকটি সঠিক জায়গার দায়িত্বে নেই। তারা যখন গবেষণাটি করেছেন, তখন ৬৩ শতাংশ ব্যাংক তাদের জানিয়েছে ব্যাংকিং খাতে আইটি বিশেষজ্ঞ ঘাটতির কথা। যেখানে ১০০ লোক দরকার, সেখানে আছে ৫০ জন। এ কারণে যারা আছে, তাদের ওপর কাজের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য শেষে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনশীলতা কমছে, কাজের ভুল বাড়ছে। কয়েক বছর আগে তারা একটি গবেষণা করে দেখেছেন, ব্যাংকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যতগুলো ভুল হচ্ছে, তার ৬৪ শতাংশই আইটির লোকজন করছে। এছাড়া বড় আরেকটি ঘাটতির জায়গা হচ্ছে সমসাময়িক বা হালনাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকা। কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যাংক বলেছিল, তাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ঝুঁকি খুব বেশি।
তবে তিনি মনে করেন, সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি জাতীয় কমিটি করা দরকার। এর পাশাপাশি, সময় এসেছে সবগুলো ব্যাংকে বিজনেস ইন্টেলিজেন্ট সফটওয়্যার চালু করার। এ ধরনের সফটওয়্যার জালিয়াতি কমাতে সহায়তা করে, যদিও সফটওয়্যারটি খুবই দামি।