রহমান মুকুল/শরিফুল ইসলাম: আলমডাঙ্গা বধ্যভূমির সীমানা পাঁচিল ঘেঁষে অবস্থিত স মিল স্থানান্তরের দাবি উঠেছে। শোকাবহ স্মৃতিধারণকারী স্থাপনার সাথেই অবস্থিত এ স মিল বধ্যভূমির পবিত্রতা একদিকে যেমন ক্ষুণ্ণ করছে, অন্যদিকে দর্শনার্থী মানুষের মানবিক অনুভূতিকে আহত করে চলেছে।
আলমডাঙ্গা শহরের উত্তরাংশে অর্থাৎ লালব্রিজের উত্তরপাশে জিকে ক্যানেলের পাশে অবস্থিত বধ্যভূমি। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় আলমডাঙ্গায় রেললাইনের কুমার নদের ওপর অবস্থিত লালব্রিজের দু পাশে ছিলো পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্প। রেললাইনের ডাউনে অর্থাৎ লালব্রিজের আলমডাঙ্গা শহরের দিকে ১টা ও কুমার নদের অপর পাড়ে অর্থাৎ কালিদাসপুরে আরেকটা মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিলো। রেললাইনের আপের দিকে গমনকারী ট্রেন লালব্রিজের আলমডাঙ্গা শহরের মাথায় দাঁড় করাতো। অন্যদিকে ডাউনগামী ট্রেন লালব্রিজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরাপরাধ যাত্রীদের ধরে ধরে নিয়ে যেতো। অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখতো। প্রথম দিকে এ সকল মিলিশিয়া নরাধম খুঁজে খুঁজে ট্রেন থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আটক করতো। তাদের সন্দেহজনক ট্রেনযাত্রীকে কালেমা কিংবা কোরআনের কোনো সূরা জিজ্ঞেস করতো। বলতে না পারলেই অবধারিত বিভীষিকাময় নির্যাতন শেষে মৃত্যু। কাউকে কাউকে আবার বিবস্ত্র করে দেখতো হিন্দু না মুসলমান। সিথিতে সিঁদুর দেখতে পেলে তো কোনো কথায় ছিলো না। সরাসরি ওই মহিলাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতো বধ্যভূমির জিকে প্রকল্পের টার্সিয়ারি খালের পাশের ওয়াপদায়। পরে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করতো। যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তখন হিন্দু-মুসলমান উভয়ই সমানভাবে এ প্রাণঘাতি নির্মমতার শিকার হতো বলে জানা যায়। মাটি খুঁড়ে এখানেই একই গর্তে ৩/৪ জনকে পুঁতে রাখা হতো।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শুরু হয় বধ্যভূমি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ। ওই সময় জিকে ক্যানেলের ঢালে বসবাসকারী ছিন্নমূল কয়েকজন মানুষ খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় লাশের বহু হাড় মাটির নিচ থেকে বের হতে থাকে। বিষয়টি গোপন থাকে না। সকলে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। বিষয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জেলা জাসদ সভাপতি এম সবেদ আলীসহ মুক্তিযোদ্ধারা দাবি তোলেন এ জায়গাটা সংরক্ষণ করে বধ্যভূমি নির্মাণের। মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুন এমপি আলমডাঙ্গার বধ্যভূমির স্মারক নির্মাণ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার আর্থিক বরাদ্দে বধ্যভূমি নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। এ বধ্যভূমির ডিজাইনার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক আলমডাঙ্গার সন্তান আব্দুস সালাম। বর্তমানে বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। এ বধ্যভূমিতে তৈরি করা হয়েছে মনোরম বাগান। এরই মধ্যে দর্শনার্থীদের ভিড় পরিলক্ষিত হয় এখানে। প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখানে ভিড় জমান। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষ অব্যক্ত বেদনাতাড়িত হয়ে ছুটে যান বধ্যভূমিতে।
এ বধ্যভূমির ঠিক সীমানা পাঁচিল ঘেঁষে অবস্থিত একটি ‘স’ মিল। প্রতিদিন এখানে গাছ কাটাকাটি অব্যাহত থাকে। বধ্যভূমির পবিত্র নিরবতা বিদীর্ণ করে ‘স’ মিলের করাতের শব্দ। কাঠের গুঁড়ো ও গুঁড়োমিশ্রিত ধুলো নিয়ত মলিন করে তুলছে এ শৈল্পিক স্থাপনাটি। সৌন্দর্যহানি ঘটাচ্ছে বাগানসহ বধ্যভূমি স্থাপনার। এ কারণে আলমডাঙ্গা বধ্যভূমির সীমানা পাঁচিল ঘেঁষে অবস্থিত ‘স’ মিল স্থানান্তরের দাবি উঠেছে।