হারিয়ে যাচ্ছে আলিয়ারপুর-সিন্দুরিয়া নবগঙ্গা নদ

 

কবীর দুখু মিয়া: চুয়াডাঙ্গা সদরের আলিয়ারপুর সিন্দুরিয়া নবগঙ্গা নদীর নাম বাংলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। নদীটি নাব্যতা হারিয়ে পানিশূন্যের দ্বারপ্রান্তে। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীর শাখা থেকে তালতলা, সুবদিয়া, বোয়ালিয়া, সিন্দুরিয়া কুটি, ঝিনাইদহের রিশখালী, ঝিনাইদহ হয়ে আকাঁবাকাঁ পথে ফরিদপুর মধুখালি, কামারখালি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। প্রায় অর্ধশত বছর আগে আলিয়ারপুর সিন্দুরিয়া নবগঙ্গা নদীর যৌবন ছিলো টইটম্বর। বর্ষার সময় বন্যার পলি মিশ্রিত পানি মাথাভাঙ্গা নদী হয়ে প্রবেশ করতো এই নদীতে। সে সময় নদ থাকত পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। নদীর তীব্র স্রোতের কলকল শব্দে এলাকা মুখরিত হয়ে উঠতো। কখনো কখনো নদীর দুই কূল বন্যার পানিতে প্লাবিত হতো। পলিমিশ্রিত পানিতে আবাদযোগ্য জমিগুলো উর্বরাশক্তি ফিরে পেতো। কৃষকরা উর্বর জমিতে দ্বিগুন ফসল ফলাতেন। সারাবছর স্বচ্ছন্দ্যে সংসার চালানোর পাশপাশি কৃষকরা অতিরিক্ত ফসলাদি বাজারে বিক্রি করতেন। জেলে সম্প্রদায় ছোট বড় মাছ ধরে হাটবাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো। এলাকার কিশোর- কিশোরীরা আনন্দে সাঁতার কাটতো। সে সময় বর্ষাকালে ঢাকাইয়া ছোট-বড় মালামালবোঝাই পাল উঠানো অসংখ্য নৌকা যাতাযাত করতো এ নদী পথে, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ঘাটে ও হাটের পাশে নৌকায় নোঙর ফেলে মালামাল আমদানি-রফতানি করতেন। নদীপথে নৌকাযাগে লোকজন দূরদূরান্তে যাতায়াত করতো। শুষ্ক মরসুমে ও নদীর বুক জুড়ে পানি থই থই করতো। কালের আবর্তে চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীর শাখা তালতলা নামক স্থানে নদীর বুকের ওপর মাটির বাঁধ নির্মাণের কারণে বর্তমান আলিয়ারপুর সিন্দুরিয়ায় নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে। পলিমাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, নদীটি টুইটম্বর যৌবন হারিয়ে শুষ্ক বক্ষ বিস্তার করে সর্বক্ষণ পানির জন্য আর্তনাদ করছে। বন্যার পানি আর প্রবেশ করে না, বর্ষার পানিতে নদীর তলদেশ সিক্ত হয় না। পলি মিশ্রিত পানির তীরবর্তী জমিগুলো উর্বরাহীন হয়ে পড়েছে, আবাদযোগ্য জমিতে পোকামাকড় বাসা বেঁধেছে। ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, কৃষকের মনে শান্তি নেই। জেলেরা পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন, নদীর মধ্যে ধান চাষের পাশাপাশি জেগে ওঠা খাস জমিগুলো এলাকার প্রভাবশালী ভূমিদূস্যরা জোরপূর্বক ভোগদখল করে পুকুর খনন, বাড়ি করা কাজে মেতে উঠেছে। সিন্দুরিয়া কুটিপাড়ার জেলেরা  জানায়, নদ সচল অবস্থায় তারা ছোট-বড় মাছ ধরে হাট-বাজারে বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালাতেন। বর্তমানে অন্য পেশায় তাদের ছেলেরা জীবিকা নির্বাহ করছেন।

মর্তুজাপুরের শাহাদত সরদার বলেন, সেকালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সিন্দুরিয়ার মর্তুজাপুর নীলকুঠি আজ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে এলাকায় ইংরেজ বেনিয়ার নীলকুঠি স্থাপন করে নীল উৎপাদন এবং  উর্বর জমিগুলো প্রজাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক দখল করে নীল চাষে বাধ্য করতো জমিদাররা। তবে কুতুবপুর ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডর হিঙ্গেরপাড়া সরু সাহেব নীলকুঠির মতো কলঙ্ক অধ্যায়ের সূচনা করেনি বলে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশ বিভক্তির আগে ১৯৪৫ সালের দিকে নীল জমিদার সরু সাহেব ৩৬শ একর সস্পত্তি চাষবাদের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সিন্দুরিয়ায় ও ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডর হিঙ্গেরপাড়া নামক দুটি স্থানে জমিদার বাড়ি নির্মাণ করে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাক সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করলে নীল সরু সাহেব সম্প্রতি জমিদার বাড়ি রেখে ভারত চলে যায়। পরে সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালের দিকে অনেক আশা করে ইংরেজ বেনিয়ার বিনরা দুর্জয় ঘাটি গড়েছিলেন সিন্দুরিয়া, হরিণাকুণ্ডর হিঙ্গেরপাড়ায়। কিন্তু সে আশা স্থায়ী হয়নি কেননা কিছুদিন পরেই ভারত উপমহাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো ইংরেজ বেনিয়ার বিনরা। মর্তুজাপুর গ্রামে সিন্দুরিয়া নীলকুঠি ও সেই সময়ের খরস্রোতা আলিয়ারপুর নবগঙ্গা নদীর ধারে সিন্দুরিয়া পাঁচপীর তলায় সাততলা নীলকুঠি ও মর্তুজাপুর হিঙ্গেরপাড়া সংলগ্ন মাঠে ৫টি কুঠি, একটি পুকুর ও একটি কুমরাখানা স্থাপন করা হয়েছিলো। আজ সবই  বিলপ্তির পথে।