পপির কালো কষ কালে কালে কেড়ে চলেছে অসংখ্য জীবন নেশার ধোয়ায় ঝাপসা এক বাপ্পী

 

কামরুজ্জামান বেল্টু: মারণনেশা হেরোইন রূপ বদলে নতুন নাম ‘ইয়াবা’ হয়ে এসেছে। এর নেশায় অসংখ্য যুবক স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে অধঃপতনের পাতালে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এদেরই একজন চুয়াডাঙ্গা মসজিদপাড়ার বাপ্পী (২৫)। গতকাল মঙ্গলবার সারাদিনই তাকে নিয়ে ঘটেছে নানা ঘটনা। যেমন কোর্ট পুলিশকে হতে হয়েছে হয়রানি, তেমনই হাসপাতালের চিকিৎসককেও খেতে হয়েছে নাকানি-চুবানি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মায়ের আকুতিতে জামিন পেয়েছে সে। মায়ের দায়ের করা মামলাতেই সপ্তাখানেক জেলহাজতে ছিলো সে।

পপি। নামটা চমৎকার। দেখতে? আরো সুন্দর। কিন্তু কষটা? প্রথমে কালো পিচের মতো। নাম আফিম। তারপর প্রক্রিয়া করে হেরোইন। ধবধবে শাদাটার নাম ওয়াইট সুগার, আর হালকা বাদামিটা ব্রাউন। এই হেরোইনের ধোঁয়ায় চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশের অসংখ্য যুবকের মেধা মিশিয়েছে ধুলোয়। পেশা কেড়ে বহু পেশাজীবীকে করেছে পথের ভিখেরি। প্রাণ ঝরেছে অসংখ্য। তছনছ হয়ে গেছে বহু সংসার। অশান্তির আগুনে পুড়েছে পিতা-মাতার হৃদয়। ঘরবাড়িও। সেই হেরোইন ফিরেছে নতুন রূপে। নাম নিয়েছে ইয়াবা। অঞ্চল ভেদে ডাক নাম ‘বাবা’। বর্ণটা গোলাপি। আকৃতি ছোট্ট। যেন গালে ঘায়ের বড়ি। এই বড়ি দ্রুত ছড়াচ্ছে শহর, শহরতলী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই ইয়াবার কবলে পড়ে বহু যুবক যেমন নিশ্চিত পতনে, তেমনই যুবতীদের অনেকেই এতে আসক্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

বহু যুবক-যুবতী ইয়াবায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার পর নানাভাবে নেশার টাকা জোগাচ্ছে। টাকা জোগাতে না পারলে সংসারের আসবাবপত্রও বিক্রি করছে। পড়শীদের ঘর-বাড়িতেও বাড়াচ্ছে হাত। মারমুখি হয়ে উঠছে নেশাগ্রস্তরা। এদেরই একজন চুয়াডাঙ্গা মসজিদপাড়ার বাপ্পী। বয়স পঁচিশের কোঠায়। তাজু ড্রাইভারের ছেলে বাপ্পীও ছিলো চালক। নেশার কারণে ওই পেশায় বেশিদিন থাকা হয়নি তার। বিয়ে করেছে। স্ত্রী আছে। সংসারে সন্তানও এসেছে। মেয়ের বয়স বর্তমানে ৫ বছর। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্ত্রী ফিরে গেছে পিতার বাড়ি। নেশার টাকা না পেয়ে মা-বোনের ওপর অত্যাচার করার এক পর্যায়ে পুলিশে নালিশ করা হয়। অসহায় মা তাছলিমা খাতুন বাদী হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা করেন। এ মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাপ্পীকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয় জেলহাজতে। গতকাল মামলার ধার্য দিনে আদালতে হাজির করা হয়। যে মা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মামলা করেছেন, তিনি ছেলেকে দেখতে যান। খাবারও দেন। এ সময় বাপ্পী তার মাকে জামিন করিয়ে নিতে পুনঃপুন অনুরোধ করে। গর্ভধারিণী মা শক্ত হন। তিনি ভাবেন, বেশিদিন হাজতে থাকলে নিশ্চয় নেশা থেকে মুক্ত হবে, ছেলে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। ছেলের অনুরোধে সাড়া না দিয়ে বাড়ি ফেরেন। অপরদিকে ছেলে বাপ্পীকে বিকেলে নেয়া হয় জেলহাজতে। পথিমধ্যে তার মুখ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে কোর্ট পুলিশকে পড়তে হয় বিপাকে। তাকে নিতে হয় হাসপাতালে। বিকেল ৪টার দিকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. এহসানুল হক মাসুম তার সহকর্মীদের নিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন। নেশাগ্রস্ততার কারণে এরকম নাকি খাদ্যে বিষক্রিয়া? বিষয়টি বুঝতে সময় লাগে। এদিকে খবর পেয়ে বাপ্পীর মা ছুটে আসেন হাসপাতালে। অসুস্থ ছেলের সেবায় নিয়োজিত হন। একপর্যায়ে তিনি আদালতের দ্বারস্ত হন। জামিন নিয়ে ছেলের হাতকড়া খুলে বাড়ি ফিরিয়ে নেন।

বাপ্পী কীভাবে নেশাগ্রস্ত হলো? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে নানামুখি তথ্য পাওয়া গেছে। বাপ্পী ট্রাক চালাতো। একদিন রাতে সড়কে ট্রাকে ডাকাতি হয়। ডাকাতদল তাকে মারপিট করে। বাম পা ভেঙে যায়। দীর্ঘদিন বাড়িতে পড়ে থাকে। ৮/১০ বছর আগে মারা গেছে পিতা। সংসারে অভাব। বেকারত্ব তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। কিছুদিন অটো চালালেও নেশা তাকে নিয়ে গেছে অধঃপতনের পাতালে। তছনছ হয়ে গেছে সংসার। গর্ভধারিনী মা তার বিরুদ্ধে মামলা করে হাজতে রাখতে ব্যাকুল। অথচ সেখানেও রাখা যাচ্ছে না তাকে। বাপ্পীকে নিয়ে বিপাকে পড়া পরিবার শুধু একটি নয়, বাপ্পীর মতো বহু নেশাগ্রস্ত যুবক গুনছে মৃত্যুর প্রহর। সংসারে জ্বলছে অশান্তির আগুন। নেভাবে কে?