বিএনপির কাউন্সিলে পদ হারাবেন বহু নেতা : হঠাত তত্পর নিষ্ক্রিয় নেতারা

স্টাফ রিপোর্টার: দলের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, আসন্ন কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপিতে মূলত শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। এতে করে পদ হারাবেন বহু নেতা ছয় বছর পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ঘোষণার পর হঠাত তত্পর হয়ে উঠেছেন দলের নিস্ক্রিয় নেতারা। পদ রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন অনেকে। হারিয়ে যাওয়া নেতাদের মুখ আবারো দেখা যাচ্ছে দলের ঘরোয়া কর্মসূচি-নয়া পল্টন-গুলশান অফিসে। স্বীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, মামলা-জেল-জুলুম থেকে নিরাপদ থাকতে যারা দলকে এড়িয়ে চলছিলেন, কাউন্সিলের মুখে এসে পদ রক্ষা-পদোন্নতির তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। কেউ কেউ দলীয় হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ছেন। মুখ দেখাতে যাচ্ছেন দলের অফিসে, আলোচনাসভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে। সারাদেশের দলীয় নেতাদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে দলের শীর্ষ নেতাদের বাসা-বাড়িতে গ্রুপিং-লবিং করছেন। মূলত, সুবিধাবাদিরা রয়েছেন বাদ পড়া আতঙ্কে। ইতোমধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ‘যারা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিল, দলের প্রতি নিবেদিত, যারা দলের সাথে বেঈমানি করেনি, অবশ্যই আমরা তাদের সম্মানিত করব। পদ আঁকড়ে থাকা অকর্মণ্য ও ব্যর্থ নেতাদের আগামী কমিটিতে নেতাকর্মীরা দেখতে চায় না। বেগম জিয়া ভবিষ্যত্ সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে দলকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত দিতে যোগ্য নেতা সৃষ্টিতে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক সিনিয়র নেতা। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, এবারের কাউন্সিলের সমীকরণ ভিন্ন। কারণ প্রতিকূল পরিবেশ এবং দুঃসময়ে হতে যাচ্ছে কাউন্সিল। ইতোমধ্যে কারা দলে ‘ইমানদার আর কারা বেঈমান কারা বিতর্কিত তা চিহ্নিত হয়ে গেছে। কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে চলছে বিএনপি। হাইকমান্ডের নির্দেশে সরকারবিরোধী দুই দফার আন্দোলনে ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, সত সক্রিয় এবং দক্ষ নেতাদের তালিকা করা হয়েছে। দলের নেতাদের বিগত ছয় বছরের কর্মকাণ্ড, নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-কারাবরণের একটি তালিকা তৈরি করে চেয়ারপার্সনের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তারাই পাবেন পদ পদবী। নির্বাহী কমিটিতে দেখা যাবে যোগ্য, তরুণ এবং দলের জন্য নিবেদিতদের। সাইড বেঞ্চে চলে যেতে পারেন দলের প্রভাবশালী অথচ বিতর্কিত অনেক নেতা। সাংগঠনিক, দাফতরিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
দলের বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নতুন ৭ জন যুগ্মমহাসচিব, ৬ জন সাংগঠনিক সম্পাদক হবেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, অতীত আন্দোলন সংগ্রামের সাথে সংশ্লিষ্টতা, ত্যাগ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যবসা ও আন্তর্জাতিকভাবে লবিং আছে এমন নেতাদের স্থায়ী কমিটিতে স্থান হবে। বয়সজনিত ও নিস্ক্রিয়তার অভিযোগে কিছু নেতা স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ পড়বেন। দলের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, আসন্ন কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। এতে করে পদ হারাবেন বহু নেতা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে আলোচিত এক নেতার এক পদ প্রস্তাব কার্যকর হলে অনেক নতুন পদ বেরিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। চেয়ারপার্সন বিষয়টি বাস্তবায়ন করবেন বলে জানিয়েছেন। দলের বেশিরভাগ নেতাই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক পদের অধিকারী।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ছয় বছর পর দলের কাউন্সিল হতে যাচ্ছে। তাই দলে উত্সাহ উদ্দীপনা বেশি। নতুন নেতৃত্বের দরজা উন্মোচিত হবে। পদ পেতে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকে আমার আশীর্বাদ পেতে ফোন করছেন। যারা এতোদিন দলের খবর নেননি তারাও সক্রিয় হচ্ছেন। আমি বলছি, কোনো পোস্টের জন্য সুপারিশ করতে পারব না। ত্যাগী, দৃঢ় সংকল্প ও ভালো চরিত্রের ব্যক্তিরাই এবার নেতৃত্বে স্থান পাবেন। তিনি বলেন, ‘নিস্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীদের পুরোপুরি বাদ দেয়া না হলেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন না তারা। দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে এবং বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলেন, তাদেরই নতুন কমিটিতে দেখা যাবে’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে দল আরো সুসংগঠিত হবে। সেখানে দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সত ও যোগ্য নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। যাতে তারা দায়িত্ব পেয়ে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। নিস্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীদের দেখতে চান না নেতা-কর্মীরা। এদিকে এতোদিন যারা কারাগারে যাওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন অথবা দল থেকে নিজেদের আবডালে সরিয়ে রেখেছিলেন তারা কেউ কেউ জামিনের জন্য আবেদন করছেন। যারা বিদেশে ছিলেন তারাও এখন দেশে ফিরছেন।
এদিকে কাউন্সিল ঘোষণার পর পদ পেতে ও রক্ষা করতে কোনো কোনো নেতা আত্মসমর্পণ করে জেলে যাচ্ছেন। দলের নেতাদের ধারণা আত্মসমর্পণ করে জেলে গেলে পদ রক্ষা পাবে। জামিন নিয়ে বের হয়ে পদ টিকিয়ে রাখতে পারবেন। আত্মগোপনে থাকার পর সমপ্রতি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবেদিন ফারুক, সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের ভূইয়া, সাবেক সংসদ সদস্য এস এ খালেক, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীসহ অনেকেই। এদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান জেল থেকে বের হওয়ার পর আর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। ৫ জানুয়ারি পল্টনে বেগম খালেদা জিয়ার সমাবেশেও আসেননি। তিনি আবারো সক্রিয় হয়েছেন। ২৬ জানুয়ারি নয়াপল্টনে সংবাদ সম্মেলন, আরাফাত রহমান কোকোর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দোয়া মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন। দলের ঢাকা মহানগরীর আহবায়ক মির্জা আব্বাস আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন। তিনি এক বছর দলে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করে এখন কাশিমপুর কারাগারে।
বিএনপি সূত্র জানায়, কাউন্সিলের তারিখ চূড়ান্ত না হলেও ১৯ মার্চ সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে তিনটি জায়গা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে দলঠি। কাউন্সিলের জন্য বিএনপির প্রথম পছন্দ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর এ স্থানেই বিএনপির ৫ম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিকল্প হিসেবে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনও বরাদ্দের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। বিএনপির সহদফতর সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র বরাদ্দ পাওয়া গেলে সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। তবে অনুমোদনের উপর এই কাউন্সিলের তারিখ নির্ভর করবে। নির্দিষ্ট স্থানে অনুমোদন পাওয়ার পরেই তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
জানা গেছে, বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুসারে কাউন্সিলের পূর্বেই বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করা হবে। এরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে মহাসচিব পদে একজনকে নির্বাচিত করবেন কাউন্সিলররা। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী কমিটিসহ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। সারাদেশের বিএনপির সাংগঠনিক জেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা কাউন্সিলর হিসেবে কাউন্সিলে অংশ নেবেন। এছাড়াও চেয়ারপার্সনের বিশেষ ক্ষমতাবলে ১০ শতাংশ কাউন্সিলরও কাউন্সিলে অংশ নেবেন। ছয় বছর আগে সর্বশেষ কাউন্সিলে দলটির গঠনতন্ত্রে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। নির্বাহী কমিটির সদস্য ২৫১ থেকে বাড়িয়ে ৩৮৬ করা হয়। এছাড়া ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’ নামে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে প্রতি তিন বছর পরপর কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে
এদিকে কাউন্সিলকে ঘিরে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন উদ্যোমে শুরু হবে পুনর্গঠন। এখন দলটির জেলা পর্যায়ের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। গত বছরের ৯ আগস্ট বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি জেলা নেতাদের পাঠানো হয়েছে। এতে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর দুই দফা সময় বাড়ানো হলেও জেলা কমিটির নেতারা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে পারেননি। পরে পৌর নির্বাচন শুরু হওয়ায় জেলা কমিটিগুলোর কাজ স্থগিত হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠকের পর জেলা কমিটির পুনর্গঠনের কাজ আবারও জোরেশোরে শুরু হয়।