লাল্টুর সৃষ্ট কথিত সেই বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তিন সদস্যের ফাঁসি কার্যকর

স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদসহ ৫ নেতা হত্যা মামলায় মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত ৩ আসামির ফাঁসি গতরাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই দফায় কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা ৩ জনের মৃতদেহের মধ্যে রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঝণ্টু, ওরফে আকবরের মৃতদেহ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুরে দাফনের প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গতরাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা ৩ জনই ছিলো চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের নূরুজ্জামান লাল্টু ওরফে নাণ্টুর সৃষ্ট কথিত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। রাশেদুল ইসলাম ঝণ্টু ছিলো চুয়াডাঙ্গা ফেরীঘাট সড়কের উদীয়মান শিল্পপতি আশাবুল হক আশা খুন মামলার আসামি। আশা খুন-গুমসহ বহু হত্যার দায়ে পার পেলেও কাজী আরেফসহ ৫ খুনের দায়ের শেষ পর্যন্ত ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হলো তাকে। মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি পলাতক রয়েছে। তারা হলেন, মান্নান মোল্ল্যা, জালাল ওরফে বাশার, রওশন আলী, বাকের আলী ও জাহান আলী। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ৫ জন গা ঢাকা দেন। এর মধ্যে মান্নান মোল্লা, জাহান ও জালাল ভারতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
গতরাত রাত ১১টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন ওরফে হাবিব ওরফে হবি এবং একই থানার কুরশা গ্রামের উম্মত ডাকাত ওরফে উম্মত মণ্ডলের ছেলে আনোয়ার হোসেন। অপর জন কুরশা গ্রামেরই মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মো. রাসেদুল ইসলাম ঝন্টু ওরফে আকবরের ফাঁসি কার্যকর করা হয় রাত পৌনে ১২টায়। ৩ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে যশোর শহরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। শহর জুড়ে পুলিশের ১২-১৪টি টিম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে। কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশ ঘিরে রাখে পুলিশ সদস্যরা। রাত ১০টা থেকে শহরের হাসপাতাল মোড়, কাঠের পুল সড়ক এবং খাজুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জেলখানামুখি সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। একইসাথে বন্ধ করে দেয়া হয় আশপাশের সংযোগ সড়কও।
কারাগারের একটি সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩ আসামির জন্য বৃহস্পতিবার বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সবাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু আনোয়ার দুপুরে এবং রাতের খাবার তেমন খায়নি। বিকাল ৪টার দিকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ঝন্টু ও আনোয়ারের পরিবারের সদস্যরা তাদের সাথে কারা অভ্যন্তরে দেখা করেন। ছিলেন ঝন্টুর ভাইপো সিদ্দিক, আনোয়ারের ভাই ইসলাম হোসেন, ইসলামের স্ত্রী কুলসুম বেগম। সে পরিবারের লোকজনের সাথে তেমন কথাও বলেনি। সন্ধ্যার দিকে পরিবারের লোকজন কারাগার থেকে বের হয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ঈমাম রমজান আলী কারাগারে প্রবেশ করেন কারা কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে। এরপরপরই প্রবেশ করে যশোরের জেলা প্রশাসক ড, হুমায়ুন কবীর, পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন। ঈমাম রমজান আলী আলাদা আলাদা ভাবে হাবিব, ঝন্টু এবং আনোয়ার হোসেনকে তওবা পাঠ করান। এর আগে তাদের ওজু করতে বলেন। কারা অভ্যন্তরের টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে দেয়া হয় তাদের। কারগারের ভেতরে একটি গাছের নিচে তৈরি করা মঞ্চে তোলা হয় আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুকে রাত ১১টা ১ মিনিটে। এ সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় পাশাপাশি দুটি ফাঁসির মঞ্চে। এরপর ওই দুজনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম। এরপর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে সাফায়েত হোসেন হাবিবের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তার লাশের ময়নাতদন্তও সম্পন্ন করা হয়। এরজন্য সময় লাগে ৩০ মিনিট।
কারা সূত্র জানায়, এর আগে ফাঁসি দেয়ার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুজন জল্লাদ নিয়ে আসা হয়। দুদিন আগে তারা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছান। এরা হলো তানভির হাসান রাজু ও হযরত আলী। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এর আগে তারা কয়েকটি ফাঁসির জল্লাদ হিসেবে কাজ করেন। ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন যশোরের জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীর, পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার শাহাজান আহমেদ, জেলর হায়দার হোসেনসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফাঁসির পর পরিবারের লোকেরা লাশ গ্রহণ করে। রাতেই তারা লাশ নিয়ে রওনা দেন কুষ্টিয়ার মিরপুরের উদ্দেশে। তারা সাথে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন। এই অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে রাতেই রওনা দেন। এর আগে যশোর কারাগারের আশপাশে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। মোতায়েন করা হয় বাড়িত পুলিশ ও র্যা ব।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মাঠে একটি সভা চলার সময় ব্রাশ ফায়ারে জাতীয় সমাজতান্দ্রিক দল- জাসদের ৫ নেতা নিহত হন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ ছাড়াও নিহত হন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরায়েল হোসেন এবং শমসের মণ্ডল। ওই হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর পর, ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন কুষ্টিয়া জেলা জজ। তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হলে, ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট ৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন, একজনকে খালাস দেন ও ১২ জনের সাজা মওকুফ করেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে, ২০১১ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই আদেশ দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রিভিউ আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়। পরে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও তা নাকচ করে দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ জনের মধ্যে ৫ জন পলাতক রয়েছে আর একজন কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন।