ঠাকুরপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে রুহুল আমিন নিহত : পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে বখতিয়ার হোসেন বকুল ও শরীফ রতন: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে রুহুল আমিন (২৬) নামের একজন নিহত হয়েছে। সে দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সুবলপুর গ্রামের বাবলুর রহমানের ছেলে। সে গরু আনতে গিয়ে বিপাকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে বলে কেউ কেউ দাবি করলেও বিজিবি বলেছে, সে ছিলো সীমান্তের ত্রাস। পরিচয় নিয়েও দেখা দেয় বিভ্রান্তি।
স্থানীয় একাধীকসূত্র বলেছে, গত বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে নিহত রুহুলসহ এলাকার ৪/৫ জন দামুড়হুদার ঠাকুরপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করে। রাত সাড়ে ৩ টার দিকে ভারতের ঢালীপাড়া সীমান্ত দিয়ে গরু পার করার সময় ভারতীয় ৮৯/৯১ মেন পিলারের কাছে মালুয়াপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় রুহুলের সাথে থাকা অন্যান্য গরুব্যবসায়ীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও রুহুল আমীন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় বলে দাবি করেছেন নিহত রুহুলের পরিবারের সদস্যরা।
গতকাল শুক্রবার সকালে খবর পেয়ে ভারতের চাপড়া থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালমর্গে নেয়। বিকেলে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ ভারতে বসবাসরত নিহত রুহুলের ২য় স্ত্রী আছিয়া বেগমের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে বলে এলাকাসূত্রে জানা গেছে। রুহুল বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সকালেই তার সুবলপুরস্থ বাড়িতে এলাকার শ শ মানুষ ভীড় জমাতে শুরু করে। রুহুলের মা রাজিয়া, স্ত্রী আসমিনা খাতুনের আহাজারিতে এলাকায় নেমে আসে শোকের মাতম। একমাত্র শিশুকন্যা নুরুন্নাহারের অশ্রুভরা দু নয়ন খুঁজে ফিরছিলো তার বাবাকে।
চুয়াডাঙ্গা-৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন, ভারতীয় নাগরিক রুহুল মণ্ডল (৪৫), পিতা-কাসিম মণ্ডল, গ্রাম-বড়ইগাতী, পোস্ট-লক্ষীপুর, থানা-চাপড়া, জেলা-নদীয়া স্থানীয় একটি বাড়িতে ডাকাতি করার সময় রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে মালুয়াপাড়া সীমান্তে বিএসএফ’র সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। পরবর্তীতে বিএসএফের সাথে যোগাযোগ করে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে আরো জানা যায় যে, উল্লেখিত ভারতীয় নাগরিকের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত শেষে তার ভাই আজিবুল মণ্ডল ও রবিউল মণ্ডল এবং স্ত্রী আছিয়া বেগম, গ্রাম-বড়ইগাতী, পোস্ট-লক্ষীপুর, থানা-চাপড়া, জেলা-নদীয়ার নিকট দাফেনেন কাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। বিজিবি আরো জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার সুভলপুর গ্রামে রুহুল আমিন (২৫), পিতা-বাবলু রহমান নামে একজন বাংলাদেশি নাগরিক নিখোঁজ রয়েছে। ওই বাংলাদেশি নাগরিকের কোনো বড় ভাই নেই এবং কোন আত্মীয় স্বজনও ভারতে নেই। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে নিহত ভারতীয় নাগরিক রুহুল মণ্ডল (৪৫) এর ভাই ও স্ত্রী আছে এবং তারা তার মৃতদেহ শনাক্তপূর্বক গ্রহণ করেছেন। সুবলপুর গ্রামের নিখোঁজ বাংলাদেশি নাগরিক রুহুল আমিন (২৫) এবং ভারতের অভ্যন্তরে নিহত ভারতীয় নাগরিক রুহুল মণ্ডল (৪৫) এক ব্যক্তি নয়। উক্ত দুটি ঘটনায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। নিখোঁজ বাংলাদেশি নাগরিকের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রেরিত পূর্বের সকল প্রেসবিজ্ঞপ্তি বাতিল করত এই প্রেসবিজ্ঞপ্তিটি গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
এদিকে নিহত রুহুল আমীনের পালিত পিতা চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের হাটকালুগঞ্জের বাসিন্দা সাজিবার রহমান বিজিবির বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করে বলেছেন, রুহুল বাংলাদেশি নাগরিক। বিএসএফের গুলিতে যে রুহুল নিহত হয়েছে সে আমার স্ত্রীর প্রথম সন্তান। এলাকার ৪/৫ জন গরুব্যবসায়ীসহ রুহুল শুক্রবার বিকেলে ভারতে গরু আনতে যায়। ২টি গরু পার করে আনার পর পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে এবং ঢালিপাড়া গ্রামে বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করে। নিহত রুহুলের মা রাজিয়া খাতুন বলেন, রুহুল তার স্ত্রী আসমিনা খাতুন ও তার একমাত্র শিশুকন্যা নুরুন্নাহারকে (৮) নিয়ে সুবলপুর গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করতো। ভারতে তার কোনো বাড়িঘর বা স্ত্রী সন্তান আছে কি-না তা আমার জানা নেই। তবে তার লাশ ভারত থেকে দেশে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলেও তিনি জানান। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য সুবলপুর গ্রামের লিয়াকত আলী জানান, রুহুল ভারতের নাগরিক নয়, সে আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তার বাড়ির হোল্ডিং নং-২০৭।
নিহত রুহুল ছিলো দু ভাইয়ের মধ্যে বড়। ছোট ভাই নুহুনবী (২০) চুয়াডাঙ্গা নিচের বাজারের একটি তেলের দোকানে কাজ করে। ২০০০ সালের বন্যার সময় নিহত রুহুলের পিতা বাবলুর রহমান নিখোঁজ হন। সেই থেকেই তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্বামী নিখোঁজের ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০০৫ সালে স্ত্রী রাজিয়া খাতুন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইন সংলগ্ন হাটকালুগঞ্জের বাসিন্দা আলুকদিয়ার আয়নালের স মিল মিস্ত্রি সাজিবার রহমানের সাথে ২য় বিয়ে করেন। সেই থেকেই তিনি স্বামীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা হাটকালুগঞ্জেই বসবাস করেন।
এলাকাসূত্রে জানা গেছে, নিহত রুহুল আগে কখনও ট্রাক্টরের আবার কখনও ট্রাকের ড্রাইভারি করতো। বছর দুয়েক থেকে সে স্মাগলিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সে গরু আনতে অবৈধ পথে প্রায়ই ভারতে যাতায়াত করতো। বছর দেড়েক আগে সে ভারতের চাপড়া থানার অন্তর্গত গাছা গ্রামে ২য় বিয়ে করে। রুহুল ভারতে চাপড়া থানার ৩টি ডাকাতি মামলার পলাতক আসামি। সে ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের মালুয়াপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের কমান্ডারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছিলো। এ ঘটনার পর থেকে সে ছিলো বিএসএফের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত নিহত রুহুলের লাশ ভারতের বড়–ইগাতী গ্রামে আছে বলে তার পালিত পিতা জানান।