ঝালাপালা লাগানো শব্দদূষণ হলেও ভাঙছে না কর্তার কুম্ভঘুম

শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে। অথচ আমরা সকলেই নির্বিকার। ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা বিপদসীমার ঊর্ধ্বে অনেকদিন ধরেই। জেলা পর্যায়ে? কম নয়। শব্দদূষণ প্রধানত সড়কগুলোতে। অলিগলির বাসিন্দা ও পথচারীদের জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে। এমনকি নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত স্কুল-কলেজ-হাসপাতালসমূহেও উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ এখন ভয়ানক মাত্রায়। শ্রুতিযোগ্য সহনীয় তথা স্বাভাবিক মাত্রা ৩৫ হলেও ৫০ ডেসিবল মেনে নেয়া যায়। অথচ বেশির ভাগ এলাকাতেই ন্যূনতম ৮৫ থেকে ১০০ ডেসিবলেরও বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হচ্ছে। ঝালাপালা লাগানো শব্দদূষণ হলেও ভাঙছেনা কর্তার কুম্ভঘুম। জাগছে না।
শুধু বাস-ট্রাক, শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ যান করিমন, নসিমনই শুধু নয়, উচ্চস্বরে মাইক প্রচারও যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর যখন কোনো মেলার আয়োজন করা হয় তখন? বাড়ি ছেড়ে পালানোর উপক্রম হয়। ঘন ঘন মসজিদের শহরেও শব্দ দূষণের বিষয়টির দিকে মোয়াজ্জিন তেমন গুরুত্ব দেন বলে মনে হয় না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ উত্থাপন আশঙ্কায় দায়িত্বশীলদেরও কেউ এ বিষয়ে কথা বলেন না। অতিরিক্ত শব্দদূষণ স্লো-পয়জনের মতো, যা প্রথমেই মানুষের মেজাজ খিটখিটে করে দেয়। বৃদ্ধি পায় রক্তচাপ, ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে মানুষের শ্রবণশক্তি। বর্তমানে বাংলাদেশে ২ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে বধির হয়ে যাচ্ছে। ২ শতাংশ মানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বধিরতার শিকার হয়েছে শব্দদূষণের কারণে! শব্দদূষণে শিশুদেরও মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটে ভয়ানকভাবে। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যে ক্ষতি হয়, তা খতিয়ে দেখলে চমকে উঠতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে চরম বিরক্তিকর, খিটখিটে মেজাজ, পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী, অস্থিরতা বৃদ্ধিকারী, শ্রবণশক্তি বিনষ্টকারী, উচ্চরক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথাধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রাসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী এক ঘাতকের নাম শব্দদূষণ। এই দূষণ রোধে আইন আছে। প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। ২০০২ সালে উচ্চ আদালত হাইড্রলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। গাড়িতে বাল্বহর্ন সংযোজনের নির্দেশ দেয়া হয়। এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আইন। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের আবির্ভাবের অনেক আগে প্রায় ৪ কোটি বছর পূর্বে স্তন্যপায়ী সদৃশ সরীসৃপ পেলিকোসার প্রাণীরা প্রথম শ্রবণশক্তির অধিকারী হয়। মানুষের এই অমূল্য শ্রবণেন্দ্রিয় বর্তমানে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দকে সহজে গ্রহণ করতে পারে। এর বাইরে অন্য কৃত্রিম শব্দের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ইন্দ্রিয়ের কোমল কলা। শুধু জনসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আমাদের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের বড় ক্ষতি হচ্ছে। আইন প্রয়োগ না থাকার কারণেই বাড়ছে শব্দদূষণ। দায়িত্বশীলদের চরম উদাসীনতা। অবস্থাদৃষ্টে বলতে হয়, ওই কর্তারা বোধহয় আগেই শব্দদূষণে বধির হয়ে গেছেন। তা না হলে শব্দ দূষণ রোধে কর্তাদের নড়াচড়া নেই কেন?