নিজামীর দোষ স্বীকার : পরে ভিন্ন মত
স্টাফ রিপোর্টার: মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী। তবে শুনানি শেষে এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আসামিপক্ষের শীর্ষ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। গতকাল বুধবার নিজামীর পক্ষে তার আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন। আগামী ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করবে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এই আপিলের শুনানি গ্রহণ করছেন।
বুধবার শুনানি গ্রহণ শেষে আদালত থেকে বের হয়ে নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে তাতে জামায়াত আমীরের অপরাধ প্রমাণিত হয় না। শেষ প্রান্তে বলেছি, অনেকগুলো অভিযোগের কোনোটিতে যদি মনে হয়, অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রেও আসামির বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করে তিনি চরমদণ্ডের পরিবর্তে অন্য কোনো দণ্ড পাওয়ার যোগ্য।’
অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে নিজামীর অপরাধ স্বীকার করা হয়েছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনারা শুনানিতে সাবমিশন যা করেছে, আমি যা বুঝেছি তাতে আমার মনে হলো জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের একজন অভিযুক্ত নেতা যে অপরাধী সেটা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা আমি যা বুঝেছি সেটিই আপনাদের বললাম।’
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, জামায়াতের মামলার ব্যাপারে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের থেকে এরকম স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে দোষ স্বীকার করে নেয়ার ব্যাপারে আমি এই প্রথম দেখলাম। দোষ স্বীকার করে নেয়ার অর্থ হলো তাদের বক্তব্যের ভেতরে তারা বলেছেন, হ্যাঁ, ঘটনাগুলো ঘটেছে। এরা এগুলোর ভেতর যুক্ত ছিলো, এটা আজকে ঐতিহাসিক সত্য। তারপরও তারা এটা করেছে তাদের বিশ্বাসের থেকে, তাই এখন যেহেতু উনার (নিজামী) বয়স হয়ে গেছে ৭৩-৭৪ বছর, উনাকে ফাঁসি দিয়ে কী হবে, অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মূল বক্তব্য জামায়াতে ইসলামী এবং এর সদস্য হিসেবে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি (নিজামী) পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যারা এখানে ছিলেন তাদের নৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু নিজামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খুন, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের।
দোষ স্বীকার করে নেয়ার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের জবাবে পরে খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দোষ স্বীকারের প্রশ্নই আসে না। তাহলে মামলা করলাম কী করে?’ তিনি বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের যে বক্তব্য আমি টিভিতে শুনলাম, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং ফৌজদারি আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাপূর্ণ।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে গত বছরের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নিজামী। গত ৯ সেপ্টেম্বর এই আপিলের শুনানি শুরু হয়। গত ২৪ নভেম্বর ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। সেদিন আদালত বলেন, ৩০ নভেম্বর এবং ১ ও ২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করবেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তি উপস্থাপন করবেন। আসামিপক্ষ পাল্টা যুক্তি তুলে ধরবেন ৮ ডিসেম্বর। সে অনুযায়ী বুধবার আসামিপক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। শুনানিকালে খন্দকার মাহবুব নিজামীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে আদালতে বলেন, ‘আমি (নিজামী) ১৯৭১ সালে ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ছাত্রসংঘের আর কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। তাই আমি বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বক্তব্য দিইনি।’
পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখেননি? ওখানে সংক্ষেপে বলা আছে বুদ্ধিজীবী হত্যায় কার দায়দায়িত্ব কতটুকু। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘তারা (নিজামীরা) যদি পাকিস্তানিদের সমর্থন না করত, তাহলে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান থেকে এসে তারা এ দেশে ৯ মাস টিকে থাকতে পারত না। তারা তিন মাস থাকত। ১৯৭১ সালে দেশে আইনশৃঙ্খলা ছিলো না। তারা ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছে মিলিটারিদের।
জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘৩০ সেপ্টেম্বরের পর উনি নেতা ছিলেন না।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিভিন্ন সংবাদে রয়েছে উনি নেতা ছিলেন। ওনার বক্তব্য প্রচার হয়েছে। যুদ্ধের শেষদিকে অনেক নর-নারী হত্যা করা হয়েছে। এটা থেকে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে উনি (নিজামী) লিডার ছিলেন?’
প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের পর খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ছিলো এর পর।’ এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৭১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিলো না। এরাই সহযোগিতা করেছেন মিলিটারিদের।’ তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘যুদ্ধের শেষে যদি এ কথা বলেন, তাহলে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে, নিজামী লিডার ছিলেন? আপনি টোকিও ট্রায়াল দেখেন।’ তখন খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘টোকিও ট্রায়াল দেখাবেন না। আপনারা তাহলে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার করছেন না কেন? পাকিস্তান তো জড়িত ছিল।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজ তো পাকিস্তান এটা অস্বীকার করছে।’ খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে, এটা সত্য। কিন্তু নিজামী ওই সময় আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র (সর্বোচ্চ) ক্ষমতায় ছিলেন না। দেশের পুলিশ বাহিনী পাক আর্মিদের পথ দেখিয়েছে। কোনো আর্মি মুভ করত না যদি পুলিশ লিড না দিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিজামীর মতো ইয়াংরা (তরুণ) পথ দেখাল আর আর্মিরা সেখানে গেল- এটা ইমপসিবল (অসম্ভব)। নিজামী একটা বাহিনীর প্রধান ছিলেন না, ছাত্রসংঘের লিডার ছিলেন।’ এ সময় তিনি আদালতে একটা মামলার প্রতিবেদন পড়ে বলেন, এ প্রতিবেদনে লেখা আছে, মাদানী বাহিনীর মতো জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ো। এভাবে রক্ত ঝরল, আর বাকি থাকল কী?
ওই সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘এটা এখন ফাঁসির দেশ হয়ে গেছে।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা বলবেন না। সৌদি, চীনে কী হচ্ছে? আমরা একটি দিলে হইচই পড়ে যায়। সৌদিতে যা হচ্ছে আমাদের দেশে তার এক পার্সেন্টও হচ্ছে না। ওদের টাকা আছে, স্ট্যান্ড আছে।’