শিশুকালে পারিবারিক বপনকৃত বীজ যখন হয় অঙ্কুরিত

ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, ঘরে বারান্দায় চাড়ি চাড়ি ধান-চাল আর মাঠে বিঘা বিঘা সম্পত্তি কি সুখের জন্য? নাকি সংসারে সচ্ছলতা আর প্রয়োজনে লাগতে পারে তথা নিরাপত্তার জন্য? নানামুখি জবাব আছে। বহু মানুষ আছেন যারা খেয়ে না খেয়ে শুধু সঞ্চয়ই করতে থাকেন, আর সন্তানেরা তা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে হিংসাত্মক হয়ে ওঠেন। চোখ মেললেই যেন এ চিত্র চোখে পড়ে। গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে চুয়াডাঙ্গার একটি অর্থশালী উচ্চ পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ এবং কটুক্তির কারণে এক সদস্যের দাফনেও অপ্রীতিকর ঘটনার খণ্ডাংশ চিত্র উঠে এসেছে।
চুয়াডাঙ্গা পুরাতনপাড়ার আছির উদ্দীন আশু মিয়া বহুল পরিচিত একজন মানুষ। তিনি সফল ব্যবসায়ী বললে কোনোভাবেই ভুল বলা হয় না। বড়বাজার পুরাতন গলির বিশিষ্ট ব্যবসায়ীই শুধু ছিলেন না তিনি, তিনি ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বও দিয়েছেন বহুদিন। দোকান মালিক সমিতির চুয়াডাঙ্গা শাখার গোড়াপত্তন তিনিই করেন। তার আগে তিনি শিল্প ও বণিক সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন। দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার নেতৃত্ব এখনও উদাহরণ হয়ে রয়েছে। গত প্রায় ৫ বছর ধরে অসুস্থ জীবনযাপন করছেন। শয্যাশায়ী। তার ৯ সন্তানের মধ্যে ৭ কন্যা দু পুত্র। দু পুত্রের ছোট রুহুল আমিন জেড গত শুক্রবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন শনিবার বাদ জোহর দাফনের প্রক্রিয়া করা হয়। জানাজার পর স্থানীয়দের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে তার এক ভগ্নিপতিকে মারধর করেন। কেন? স্থানীয়দের বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আড়ালে সম্পদ সম্পত্তি নিয়ে পূর্ব বিরোধের জের ধরে কটুক্তি।’ মরহুম রুহুল আমিন জেডের স্ত্রীকে তার এবং তার পৈত্রিক সম্পদ সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দিতেই সোচ্চার প্রতিবেশীরা।
বাঙালি সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, তা হলো- এক প্রজন্ম গড়ে, পরের প্রজন্ম ভোগ করে। প্রবাদটা পূর্বে কতোটা কার্যকর ছিলো তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, এক প্রজন্ম গড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরের প্রজন্মকে নষ্ট করতেই বেশি দেখা যায়। আর বেশি বেশি সম্পদ সম্পত্তি থাকলে? কাড়াকাড়ি এক পর্যায়ে হানাহানিতে রূপ নেয়। হতাহত পরায় হাতকড়া। ভোগ দূরাস্ত, ভিটেয় ঘুঘু চরার উপক্রম হয়। এ থেকে পরিত্রাণ? ত্যাগ হয়তো কোনো কোনো পরিবারে শান্তি আনতে পারে, তবে সবক্ষেত্রে নয়। একের ত্যাগ অন্যের লালসা এক পর্যায়ে যে সর্বগ্রাসীও করে তোলে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৈত্রিক সম্পদ সম্পত্তি বণ্টনের বিধি-বিধান দেশে বিদ্যমান। এরপরও হানাহানি কেন? সর্বস্তরে সব কিছুই আইনের দৃষ্টিতে বণ্টন সম্ভব হয় না। পারিবারিক উদারতা যেমন থাকে, তেমনই থাকে হাতিয়ে নেয়ার মানসিকতা। দুর্বলকে কীভাবে ঠকিয়ে সবল সর্বগ্রাসী হবে সে চক্রান্ত তো বাঙালি সমাজের চেনা রূপ। এ থেকে বের হতে হলে দরকার পারিবারিক সচেতনতা। বিশেষ করে শিশুকালেই শিশুর মগজে ভাগাভাগির বীজ বপনের রেওয়াজ থেকে বের হতে হবে আমাদের। কীভাবে? দরকার গবেষণা।
এক সময় বাঙালিদের একান্নবর্তী পরিবার ছিলো গর্বের। এখন? অসম্ভব প্রায়। কেন? স্বার্থান্ধতাই শুধু নয়, শিশুকালে সেই খেলনা থেকে শুরু করে ঘুমোনার স্থান, বালিশ কাঁথা ভাগাভাগির পাশাপাশি না বুঝেই ‘তুমি খেয়ে নাও না হলে ওকে দিয়ে দেবো? তুমি না নিলে ওটা ওই অমুক নিয়ে নেবে।’ এসব উক্তিই যে অজান্তে বপন হয় ভাগাভাগির বীজ তা ক’জনই আর উপলব্ধি করি? তাছাড়া ভাই ভাই কতোদিন খুব আপন, যতোদিন বিয়ে হয়নি। এটাও সমাজের চেনা রূপ। বদলায় কেন? সংসারে আসা নতুন নারীর মধ্যে সুপ্তভাবে অঙ্কুরিত হওয়া ক্ষমতায়ন নামক বীজ। সেটাও পরিবার থেকেই পাওয়া।