চুয়াডাঙ্গার গোপীনাথপুরে স্ত্রীকে খুন : স্বামী পলাতক

 

স্টাফ রিপোর্টার: মাকে খুন করছে দেখেও প্রাণভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায়নি দু মেয়ে। আটকাতে পারেনি খুনি পিতা রহমকে। গতকাল রোববার ভোরে ফজরের আজানের একটু আগেই স্ত্রী আলেয়া খাতুনকে (৪৫) খুন করে পালিয়ে যায় ঘাতক স্বামী আব্দুর রহমান ওরফে রহম আলী। সকাল ৮টার দিকে খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের পদ্মবিলা ইউনিয়নের গোপিনাথপুর মাঝেরপাড়ার বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ যখন ৪ সন্তানের জননী আলেয়া খাতুনের জবাই করা মৃতদেহ উদ্ধার করে, তখন গ্রামের জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন- আহারে, আলেয়া খাতুন যখন বলতো, আমার স্বামী রহম আমাকে জবাই করবে, মেরে ফেলবে, তখন বিশ্বাস হয়নি। এখন দেখছি সত্যিই রহম তার স্ত্রী আলেয়া খাতুনকে জবাই করে পালিয়েছে। রহমান ওরফে রহমনের এটাই প্রথম খুন নয়, এর আগেও তার এক স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। স্ত্রী রেশপতিকে হত্যার পর লাশ গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে বলে আত্মহত্যা। অবশ্য সেই ঘটনায় রহমকে কয়েক বছর জেল হাজতেও থাকতে হয়। এছাড়াও রহমের বিরুদ্ধে গ্রামে অভিযোগের অন্ত নেই। মামলাও রয়েছে বেশ কয়েকটি। স্থানীয়রা এ সব তথ্য জানিয়ে রহমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। যে মেয়েদের সামনে তার মা আলেয়া খাতুনকে খুন করেছে পিতা রহম, সেই দু মেয়ের চোখে মুখে এখন আতঙ্কের ছাপ। ভয়ঙ্কর খুনি পিতার ভয়ে মাঝে মাঝেই আতকে উঠছে ওরা।

পুলিশ ও এলাকাসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের গোপিনাথপুর মাঝেরপাড়ার আবু তালেব ওরফে আবুল মণ্ডলের ছেলে রহমান ওরফে রহম আলী বাড়ির সাথে রাইসমিল বসিয়ে ব্যবসা করে। আর শীত এলে খেজুরগাছ কাটাসহ চাষের কাজ করে। মারকুটে রগচটা প্রকৃতির সন্দেহপ্রবণ বাতিকগ্রস্থ রহম আলীর সাথে তার স্ত্রী আলেয়া খাতুনের সাথে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো। স্ত্রী অন্যের সাথে পরকীয়া করে সন্দেহে কারণে অকারণে অপবাদ দিয়ে মারধর করতো। কিছুদিন আগে পুকুরে মোষ ধোয়াতে গিয়ে পানিতে খুশে হত্যার অপচেষ্টা চালায় রহম। মাঠে নিয়েও হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। পরে অবশ্য রহম বিষয়টিকে তামাশা বলে ঘটনা হাল্কা করে নেয়। তবে খুনের হুমকি দিতো মাঝে মাঝে। হুমকির কারণে আলেয়া খাতুন গ্রামের বেশ কয়েকজন মাতবরসহ জনপ্রতিনিধির নিকট অভিযোগ করে বলেন, আমাকে জবাই করে ফেলবে। মাঝে মাঝে গাঁজা খেয়ে বাড়ি ফিরে জবাই করার মতো আচরণও করে। এসব কথা অবশ্য তেমন গুরুত্ব পায়নি মাতবরদের নিকট। তবে গতকাল রোববার সকালে লাশ উদ্ধারের সময় অধিকাংশ লোকের মুখেই ছিলো আফসোস। বাঁচাতে না পারার দীর্ঘশ্বাস।

নিহত আলেয়া খাতুনের রয়েছে ৪ সন্তান। এদের মধ্যে দু ছেলে ছিলো পাশের পৃথক ঘরে ঘুমিয়ে। একই ঘরে ঘুমোয় সদ্য বিয়ে দেয়া বড় মেয়ে রহিমা খাতুন (১৬) ও ছোট মেয়ে হালিমা খাতুন (৭)। এই দু মেয়ের সামনেই ঘটে নৃশংসতা। অবশ্য মাকে জবাই করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে খুনি পিতা পালিয়ে যাচ্ছে দেখেও দু মেয়ের এক মেয়েও ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। খুন করে ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকে পালানোর পরই দু মেয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে। তখনই পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা বড় ভাই, ভাবী, ছোট ভাইসহ অন্যরা এসে ঘরের দরজা খুলে দেখে আলেয়ার রক্তাক্ত মৃতদেহ। ততোক্ষণে খুনি আত্মগোপনে। স্থানীয়রা বলেছে, সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত রহম আলী দীর্ঘদিন ধরেই তার স্ত্রী আলেয়াকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। চরিত্রহীনা বলে অভিযোগ তোলার কারণে যেমন লেগে থাকতো ঝগড়া, তেমনই নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হতো তাকে। রহম এমনভাবে নির্যাতন করতো যে ভাষায় বর্ণনা করাও কঠিন। কেউ ঠেকাতে গেলে তাকেই স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক বলে অপবাদ দিতো। মূলত সে কারণে তেমন কেউই ওদের ঝগড়াসহ নির্যাতনের কান্নায় কান দিতো না। এরই মাঝে গতকাল রোববার ভোররাতে নৃশংসভাবে জবাই করে পালিয়েছে রহম।

স্থানীয় প্রবীণদের অনেকেই আব্দুর রহমান ওরফে রহম আলী সম্পর্কে তথ্য দিতে গিয়ে নাকসিটকে বলেছেন, রহমকে প্রকাশ্যে মেরে ঝুলিয়ে রাখলেও গায়ের ঝাল মিটবে না। কারণ, ওই রহম দীর্ঘদিনের রগচটা অমানুষ। বিয়েও করেছে বেশ ক’টা। আলেয়া খাতুন প্রথম স্ত্রী নয়। প্রথমে রহম বিয়ে করে দামুড়হুদার আশুরা নামের এক মেয়েকে। প্রথম বিয়ের কিছুদিনের মাথায় গ্রামেরই মৃত তাইজেল হোসেনের মেয়ে রেশপতির ঘরে গিয়ে ধরাপড়ে রহম। স্থানীয়রা ধরে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। অপরদিকে প্রথম স্ত্রী আশুরা অগত্যা বাপের বাড়ি ফিরে যায়। দাম্পত্য বিচ্ছেদ ঘটে। বাপের বাড়ি ফিরে আশুরা প্রাণে রক্ষা পেলেও বাঁচতে পারেনি দ্বিতীয় স্ত্রী রেশপতি খাতুন। বিয়ের দু বছরের মাথায় বাড়ির আঙিনার কাঁঠালগাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ঝুলন্ত মৃতদেহ। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে। অবশ্য মামলায় তাকে তিন বছর জেল হাজতে থাকতে হয়। তৃতীয় বিয়ে করে একই গ্রামের আওলাদ হোসেনের মেয়ে জাহানারা খাতুনকে। দু সন্তান আসে। রহম আলীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। জাহানারা খাতুন তার দু সন্তান নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। রহমের সঙ্গ ছাড়ে। অবশ্য পরে জাহানারা নতুন সংসার পেতেছে। জাহানারা খাতুনের সাথে বিচ্ছেদ হলে রহম বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী গ্রাম নিমতলার মফিজ উদ্দীনের মেয়ে আলেয়া খাতুনকে। আলেয়া খাতুন তখন ছিলো অন্যের স্ত্রী। পরকীয়া সম্পর্ক করেই রহমের সাথে সুখের সংসার পাতে আলেয়া খাতুন। পরকীয়া করে নতুন সংসার পাতার পর থেকেই মূলত রহমের মধ্যে সন্দেহের ঘুণ ধরে। সেই ঘুণেই কুরে কুরে খেয়েছে আলেয়াকে। শেষ পর্যন্ত সেই সন্দেহের কারণেই খুন হতে হলো তাকে। যদিও আলেয়ার সংসার দীর্ঘ প্রায় দু যুগের। বড় ছেলে চাঁদ মিয়া বিয়ে করে পৃথক সংসার করে। অপর ছেলে সুরুজও থাকে পৃথক। আর দু মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে ক’দিন আগে। ছেলে মেয়েরা বলেছে, আমাদের মা আলেয়া খাতুনই তার পিতার বাড়ির জমি বিক্রি করে নিয়ে এনে ওই খুনি রহমের হাতে তুলে দেয়। সেই টাকা দিয়েই বাড়ির সাথে রাইস মিল বসায়। কিছু জমি কিনে আবাদ শুরু করে।

গতকালই আলেয়ার লাশ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়ন করেন চুয়াডাঙ্গা সদর থানার এসআই মহাসিন আলী। মৃতদেহ দেখতে এলাকার উৎসুক নারী-পুরুষ ভিড় জমায়। নিকটজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। গতকালই নিজ গ্রামে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। নিহত আলেয়ার বড় ছেলে চাঁদ আলী বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ খুনি রহমকে ধরতে পারেনি।