টাঙ্গাইলে মা-ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ : পুলিশের গুলি নিহত ৩

 

স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে মায়ের সামনে ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও পরে মাকেও বিবস্ত্র করে নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এতে পুলিশ গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে দুজন ও একজন ঢাকায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান। এরা হলেন ফারুক হোসেন, শামীম হোসেন ও শ্যামল চন্দ্র শীল। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ও লাঠিচার্জে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশের এলাকাসহ পাশের ঘাটাইল উপজেলার হামিদপুরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার সকল দোকানপাট ও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ  হয়ে যায়। এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, গত মঙ্গলবার কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামে মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও হাফিজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বখাটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার এলাকাবাসী কালিহাতী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে ১০ জন নিরীহ মানুষ আহত হয়। এর জেরে গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঘাটাইল উপজেলার আঠারোদানা ও কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ মাইকে ঘোষণা দিয়ে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। প্রথম মিছিলটি বের হয় ঘাটাইল থানার হামিদপুর বাজারে। এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন মিছিল নিয়ে কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সময় ঘাটাইল থানা পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজনের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি হয়। পুলিশ লোকজনের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্চ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়লে কালিহাতীর সাতুটিয়া এলাকার লোকজনও বাসস্ট্যান্ডে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এখানেও পুলিশ প্রথমে তাদের বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। বন্ধ হয়ে যায় এলাকার দোকানপাট ও কালিহাতী-ময়মনসিংহ সড়কে যানবাহন চলাচল। পরিস্থিতির অবনতি হলে একপর্যায় পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ ও গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসস্ট্যান্ডের পাকা সড়কে লুটিয়ে পড়ে এবং ৫০ জনেরও বেশি আহত হয়। নিহতদের মধ্যে কালিহাতী এলাকার কবির হোসেন ও ফারুক। এদের মধ্যে কবির হোসেন টাঙ্গাইল মেডিকেলে আর ফারুক হোসেন কালিহাতী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মারা যান। নিহত অপর জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আহতদের প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ও পরে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত সুমন জানান, শুক্রবার বিকেলে মাইকিং করে ঘাটাইলের আঠারোদানা ও সাতুটিয়া গ্রামের লোকজনকে সমবেত করা হয়। প্রথমে হামিদপুর বাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। সেখাই পুলিশ বাধা দেয়। পরে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। পরে জনতা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় সংঘর্ষ হামিদপুর বাজার থেকে কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন।

স্থানীয় লোকজন জানায়, কালহাতী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল হাজারীর ডাকে সাতুটিয়া গ্রামের লোকজন বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয় এবং একপর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কালিহাতীর সাতুটিয়া ও ঘাটাইলের আঠারোদানা গ্রামের সাধারণ মানুষ ছিলো বেপরোয়া। জনগণ রাস্তায় টায়ারে আগুন দিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঘাটাইল ও কালিহাতী থানা পুলিশও বিক্ষোভকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ছিল মারমুখী।

উল্লেখ্য, কালিহাতীর সাতুটিয়া গ্রামে মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় কালিহাতী থানায় মামলা হয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা এ ঘটনার মূলহোতা বলে জানা গেছে। তাদের বৃহস্পতিবার সকালে নিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। তবে সে মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজন আহত হয়। পরে লাঠিচার্জের প্রতিবাদে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক প্রায় ১ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে বিক্ষোভকারীরা। এলাকার মহিলারাও এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

কালিহাতী থানার ওসি শহীদুল ইসলাম জানান, শুক্রবার বিকেলে কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া ও ঘাটাইলের আঠারোদানা গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ মিছিলের নাম করে পুলিশের ওপর হামলা করে। এ হামলা ঠেকাতে পুলিশ বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় ৫ পুলিশ আহত হয় বলে তিনি জানান। পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেন। তবে তিনজনের মৃত্যুর খবর তিনি নিশ্চিত করেন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হাফিজ উদ্দিনকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে টাঙ্গাইল আদালতে পাঠানো হয়। এর আগে অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম রোমাকে ঘটনার দিনই গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতে তোলা হলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ ব্যাপারে কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোজহারুল ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু) ও পৌরসভা চেয়ারম্যান আনসার আলী বলেন, ঘটনাটি খুবই অনাকাঙ্খিত ও দুঃখজনক। বিক্ষুব্ধ জনতাকে ম্যানেজ করতে পুলিশেরও যেমন চেষ্টার ত্রুটি ছিলো না, তেমনি বাড়াবাড়ি ছিলো। ফলেই প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা অবশ্যই তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। একই সাথে এলাকাবাসীকেও ধৈর্য ধরার জন্য আহ্বান জানাবো। আমরা সাতুটিয়া গ্রামের লজ্জাজনক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থার আশ্বাস দিচ্ছি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার এলাকাবাসীর বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জের বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হয়। ৬টার দিকে স্থানীয় নেতরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধানের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার টাঙ্গাইল (উত্তর) শরীফুল ইসলাম এবং গোপালপুর সার্কেলের এএসপি জমির উদ্দিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এরই জের ধরে শুক্রবার এলাকায় মাইকিং করে মানুষ সমবেত হয়। তারপর প্রথমে হমিদপুর বাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সমবেত হয়। সেখানেই পুলিশ ও জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মঙ্গলবার দুপুরে কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম রোমা তার লোকজন নিয়ে ঘাটাইলের এক শ্রমজীবী ছেলে ও তার মাকে বাড়ির উঠোনে বিবস্ত্র করে অমানবিক নির্যাতন করে। এ ঘটনায় কালিহাতী থানায় মামলা হয়েছে।