গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কর্তব্য অবহেলার অভিযোগ
মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবারও চিকিৎসা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এবার চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলার বলি হয়েছেন মানজুরা খাতুন (৩২) নামের এক প্রসূতি। সন্তান প্রসবের লক্ষ্যে গতকাল শনিবার সকালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির পর বিকেলে তার মৃত্যু হয়। ভালো চিকিৎসার জন্য রোগীর স্বজনদের সকাল থেকে বারবার রেফারের আকুতি কর্ণপাত না করলেও তার মৃত্যুর পর রেফার করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নার্স ও চিকিৎসক। এ ঘটনায় রোগীর স্বজন ও স্থানীয় লোকজন হাসপাতালের সামনে লাশ নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও দোষীদের শাস্তি দাবি আটকে গেলো সরকারি তদন্তের দোহাই দিয়ে। মানজুরা খাতুন গাংনীর করমদি গ্রামের মহিবুল ইসলামের স্ত্রী।
মানজুরার জামাই রেজা জানান, গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে প্রসব বেদনা উঠলে শাশুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন তিনি। তারপর থেকে একবার ডাক্তারের কাছে আরেক বার নার্সের কাছে ধর্না দিয়েও সুচিকিৎসা কিংবা পরামর্শ মেলেনি। সময় গড়ানোর সাথে সাথে মানজুরার প্রসব বেদনা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে অন্য কোনো হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে নেয়ার দাবি জানালেও তাতে বাধ সাধেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত নার্স শহিদা নাসরিন, মল্লিকা এবং কয়েকজন আয়া। হাসপাতালেই স্বাভাবিক প্রসব হবে এমন দৃঢ় আশ্বাস দেন তারা। বাইরে গিয়ে টাকা খরচ করে সিজারিয়ান অপারেশন না করার পরামর্শ দেন নার্স ও আয়ারা। কিন্তু এতে রেজাসহ পরিবারের সদস্যদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসলেও রোগীর অবস্থা দেখে কিছুতেই মন মানছিলো না। তাইতো আবারো নার্স ও চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রেফারের দাবি জানান তিনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন প্রসূতি সন্তান প্রসব করলে তার স্বজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ৫শ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বকশিস আদায় করেন দায়িত্বরত নার্স ও আয়ারা। মূলত এ কারণেই তারা রোগীকে আটকে রাখেন। প্রসূতি মা ও তার গর্ভের সন্তানের চেয়ে আয়া-নার্সদের বকশিসের টাকা অনেক বেশি মূল্যবান বলে মন্তব্য করেন অনেকেই। এ বকশিস প্রাপ্তির আশায় গত বছরও এ রকম দুটি ঘটনা ঘটেছিলো।
নার্স ও চিকিৎসকদের এমন আচরণের এক পর্যায়ে মানজুরা খাতুনের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর আলোর মুখ দেখা হয়নি গর্ভের সন্তানের। তার স্বজনরা ক্ষোভে লাশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে রেখে প্রতিবাদ জানান। দাবি তোলেন দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজনের ভিড় জমতে থাকে। তারাও প্রতিবাদে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ঘটনাস্থলে আসেন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন। তবে অভিযুক্ত নার্স শহিদা নাসরিন ও মল্লিকা দাবি করেন রোগীর অবস্থা ভালো ছিলো, তাই স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চা প্রসব হবে বলে আমরা দেরি করি। কিন্তু বিকেলে হঠাত করে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে চিকিৎসা দিয়েও লাভ হয়নি। আরএমও এমকে রেজা জানিয়েছেন, রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে দুপুরে তাকে মেহেরপুর বা কুষ্টিয়া নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের লোকজন নিয়ে যাননি। অন্যদিকে মেডিকেল অফিসার ডা. মিলন হোসেন জানান, আমি রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে হার্ডসল স্যালাইন দিলেও তার অবস্থার উন্নীত না হওয়ায় বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করতেই তার মৃত্যু হয়।
তবে চিকিৎসকদের এ দাবির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে রোগীর স্বজনরা। তারা মানুষের সামনের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন মিথ্যা দাবি করা হচ্ছে। দুপুরে বা সকালে কোনো চিকিৎসক এমন পরামর্শ দেয়নি। নার্সদের কাছে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিতে পারেন। তবে নার্সরা এমন কোনো পরামর্শ কিংবা অর্ডার তাদের দেননি।
এদিকে লাশ নিয়ে অবস্থানের পর মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজামান খোকন, গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম হোসেন, এবং আরএমও এমকে রেজা রোগীর পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপ করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়ে মানজুরার লাশ বাড়ি নিয়ে যান স্বজনরা। এর মধ্যে দাবি পূরণ না হলে হত্যামামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছে নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগেও কয়েকবার নার্স-চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস ও বিভাগীয় তদন্তের মধ্যে তা আটকে ছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দোষীদের রক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারও তেমনই আশঙ্কার কথা জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, হাসপাতালের কয়েকজন নার্স ও চিকিৎসক সেবার নামে রীতিমত ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে। নার্স-চিকিৎসকদের পছন্দের ফার্সেসি থেকে ওষুধ ক্রয় ও কমিশনভুক্ত ডায়গনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করানোর ঘটনাতো অহরহ। পছন্দের ফার্মেসি থেকে ওষুধ না কিনলে কয়েকজন নার্স রোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসা দেন না। সেবার পরিবর্তে নার্সদের ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে পড়েন রোগী ও তার স্বজনরা। অপরদিকে টেস্ট ভালো হয়নি দাবি তুলে পছন্দের ডায়গনস্টিক সেন্টারে রোগীদের যেতে বাধ্য করেন কয়েকজন চিহ্নিত চিকিৎসক। তবে এবারো আগের কয়েকটি ঘটনার মতো তৎকালিন সিভিল সার্জন কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতোই বর্তমান সিভিল সার্জন মজিবুল হক জানালেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।