দীর্ঘ মেয়াদে সেশনজটের আশঙ্কা : লাখো শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষাও অনিশ্চিত
স্টাফ রিপোর্টার: অর্থমন্ত্রীর অসংলগ্ন বক্তব্য শিক্ষক আন্দোলনকে উসকে দিয়েছে। ফলে শিক্ষকরা ক্রমশ কঠোর আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন। তারা অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এছাড়া বক্তব্য প্রত্যাহার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার জন্য শিক্ষকরা অর্থমন্ত্রীকে আলটিমেটাম দেন। অন্যথায় তারা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। বুধবার বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেন।
এদিকে বুধবার থেকে পে-স্কেলের বেতনবৈষম্য নিরসনসহ চার দফা দাবিতে তারা লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেছেন। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। আজ সব সরকারি কলেজে কর্মবিরতি পালিত হবে। আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও বিসিএস শিক্ষা সমিতি পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে আলাদা জরুরি সভায় বসবে। শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর ক্লাস এবং পরীক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে।
শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল এবং বিএনপি। বুধবার ১৪ দলের নেতারা শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই দিন বিএনপির নেতারা শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বর্তমান সরকারের সাত বছরের শাসনামলে এই প্রথম দেশের সব বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ একযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নেমে এসেছেন। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ইসুতে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনের রেকর্ড রয়েছে। অভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকদের একযোগে আন্দোলনের ঘটনা নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা।
অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আন্দোলনরত শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে। তাদের কর্মবিরতির কোনো যুক্তি নেই। তারা জানেনই না নতুন বেতন কাঠামোতে তাদের জন্য কি আছে আর কি নেই। একই সাথে অধ্যাপকদের পদোন্নতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের করাপ্ট প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। প্রত্যেকে এখানে সহজেই অধ্যাপক হয়ে যান। সহযোগী অধ্যাপকদের তারা খেয়াল-খুশিমতো পদোন্নতি দেন। অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের পর তাৎক্ষণিকভাবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি পরদিন থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়।
পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল এবং সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের আপগ্রেডের দাবিতে সব সরকারি কলেজের শিক্ষকরা আজ কর্মবিরতি পালন করছেন। অপরদিকে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিবের সমান বেতন ও পদমর্যাদার দাবি এবং আন্দোলন ও অধ্যাপকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন।
সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব আইকে সেলিমউল্লাহ খন্দকার বুধবার বলেন, দু দফা দাবিতে তারা এ কর্মবিরতি পালন করছেন। বিভিন্ন কলেজ, আলিয়া মাদরাসা, কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট, শিক্ষাবোর্ড, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, নায়েম (জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি), শিক্ষা ভবন, বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাস্টার্সের প্রিলিমিনারি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। কলেজের অভ্যন্তরীণ, ইনকোর্স-টিউটোরিয়ালসহ অন্য পরীক্ষাও হবে না বলে জানা গেছে। তবে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) অনুরোধে ৩৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা নেবেন তারা। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা না নেয়ার বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক নোমান-উর রশীদকে তারা সমিতির পক্ষ থেকে জানিয়ে দিয়েছেন।
শিক্ষক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, তারা প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাকি ২৬টি ক্যাডার কর্মকর্তার সাথে যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে বুধবার বিকালে ২৬ ক্যাডার সমন্বয় কমিটি বৈঠকে বসেছে। বৈঠক শেষে রাত পৌনে ৮টায় বিসিএস সমিতির মহাসচিব বলেন, সমন্বয় কমিটি বিসিএস শিক্ষকদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। তিনি আরও জানান, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিসিএস শিক্ষক সমিতি পুনরায় বৈঠকে বসবে। সরকারি কলেজ শিক্ষকদের দুটি দাবি হচ্ছে- সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখা এবং সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের আপগ্রেড করা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মসূচি: সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিবের সমান বেতন নির্ধারণ ও মর্যাদা প্রদানসহ চার দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলনে আছেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষক মঙ্গলবার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে এ কর্মসূচি পালিত হয়। পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য ফেডারেশন আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ক্লাবে বসছে।
শিক্ষকদের বাকি দাবি হচ্ছে- ঘোষিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদা পুনঃস্থাপন। এসব দাবি তারা অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন করে। এতে বক্তৃতা করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মহা. রেজাউল করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ প্রমুখ। মানববন্ধনে সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক মুহম্মদ নূরুল্লাহ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র, শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম, অধ্যাপক প্রণব কুমার পাণ্ডেসহ তিন শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা তার বক্তৃতায় বলেন, তারা মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলনে নেমেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) শিক্ষক সমিতি গতকাল বুধবার দুপুর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন বাকৃবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি। বুধবার দুপুরে জরুরি বৈঠকের মাধ্যমে শিক্ষক সমিতি এ সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ওই জরুরি বৈঠকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার শরীফুল ইসলামের সভাপতিত্বে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ইকবালের সঞ্চালনায় সভায় ১৩২ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সভায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বুধবার সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। গত মঙ্গলবার রাতে শিক্ষক সমিতির এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার কর্মবিরতি পালনের কথা রয়েছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খবির উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার বলেছেন, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যা বলেছেন তা অনভিপ্রেত ও অসংলগ্ন।
গতকাল বুধবার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এএইচএম আক্তারুল ইসলাম জিল্লু স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর দেয়া বক্তেব্যের প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন ও কালো ব্যাজ ধারণের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া অন্য আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। অন্যথায় অর্থমন্ত্রীকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।
স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে অনড় রয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকরা। খুবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আহমেদ আহসানুজ্জামান অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, সারা দেশে সর্বোচ্চ এক হাজার সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত সিনিয়র অধ্যাপককে সর্বোচ্চ স্কেলে বেতন বাড়াতে মাসে ৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত লাগবে। রাষ্ট্রের জন্য এটা বড় বিষয় নয়। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. সারওয়ার জাহান অর্থমন্ত্রী তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ন্যাশনালিস্ট টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, সব শিক্ষকই এখন স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের পক্ষে। কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক গোলাম কাদের বলেন, মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে তারা আন্দোলন করছেন। খুবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. সারওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের কারণে তারা মর্মাহত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষক সমিতি। একই সঙ্গে স্বতন্ত্র পে-স্কেলের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচির প্রথমদিনে তারা এসব দাবি জানান। শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবুল হোসেনের সঞ্চালনায় অন্য শিক্ষক নেতারা এতে বক্তব্য দেন। এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি।