কবি নজরুলের গান-কবিতা-বাণী বাঙালি জাতির জন্য উদ্দীপনা ও সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে

স্মৃতি বিজড়িত চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গাসহ সারাদেশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম প্রয়াণ দিবস পালিত

 

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতায় চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গায় পালিত হয়েছে। এছাড়া জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনাসভা, কবিতা আবৃত্তি, নজরুল পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বিদ্রোহী কবির ৩৯তম প্রয়াণ দিবস গতকাল বৃহস্পতিবার পালন করা হয়।

ঢাকা অফিস জানিয়েছে, ভোর থেকে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিয়াতে ফজরের নামাজের পর কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হয়। ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধি ও স্মৃতি কমপ্লেক্সে কবিপ্রেমীদের ঢল নামে। সকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক সমিতি ও ছাত্র-ছাত্রীরা কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও নজরুল মঞ্চে আলোচনা করেন। কবি পরিবারের পক্ষ থেকে কবির নাতনি মিষ্টি কাজীসহ অন্য সদস্যরা পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন। জাতীয় কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, বিএনপির পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন, দলের মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ, সাইফুর রহমান সোহাগের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পরিষদ, নজরুল সঙ্গীত সংস্থা, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, নজরুল একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ভাসানী সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ, আন্তর্জাতিক নজরুল চর্চাকেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নজরুল গবেষক প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, ঢাবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেগম আক্তার কামাল, সামাজিক বিভাগ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান, কলা অনুষদের ডিন আখতারুজ্জামান, সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. লীনা তাপসী খান। সঞ্চালনা করেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমরা নজরুলকে সাথে নিয়েই বেড়ে উঠেছি। তার কবিতা গান শুনে এবং পড়ে আমাদের চিন্তার বিকাশ ঘটেছে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তার গান ও কবিতা আমরা কণ্ঠে ধারণ করেছি। তার কালজয়ী সৃষ্টিকর্মের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস তিনি আমাদের সাথে ছায়ার মতো ছিলেন, আছেন আজও। ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কবি নজরুলের গান, কবিতা ও বাণী বাঙালি জাতির জন্য উদ্দীপনা ও সঞ্জিবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে। নজরুলের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপতত্পরতার বিরুদ্ধে জাতিকে নজরুল চর্চা ও অধ্যয়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নজরুলের মানবতাবাদী চেতনা, সাম্য ও মুক্তবুদ্ধির ধারণায় আমাদের আত্ম-জিজ্ঞাসা প্রবণ হতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে এর তাত্পর্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। নজরুল মানুষে-মানুষে কোন ভেদাভেদ দেখেননি, তার রচনা মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আলোচনা, নজরুল পুরস্কার ২০১৪ প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব বেগম আকতারী মমতাজ। মুখ্য আলোচক ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ইকরাম আহমেদ। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত নজরুল পুরস্কার-২০১৪ পেয়েছেন গবেষণায় ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও নজরুল সঙ্গীতে শবনম মুশতারী। তাদের হাতে পুরস্কারের অর্থ ও স্মারক তুলে দেন প্রধান অতিথি আসাদুজ্জামান নূর। পুরস্কার গ্রহণ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেকোনো পুরস্কার, পেলে আনন্দ লাগে, উদ্দীপ্ত হই। নজরুলের নামাঙ্কিত পুরস্কার পেয়ে আমিও আনন্দিত ও উদ্দীপ্ত। শবনম মুশতারীও উচ্ছ্বসিত প্রকাশ করেন তার বক্তব্যে।

এদিকে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নজরুল স্মৃতি বিজড়িত কার্পাসডাঙ্গায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টায় আলোচনাসভা, কবিতা পাঠ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা পয়স্তীর উদ্যোগে আলমডাঙ্গায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। সাহিত্য পত্রিকা পয়স্তীর সম্পাদক আতিকুর রহমান ফরায়েজীর সভাপতিত্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক আ.ফ.ম. সিরাজ সামজী, সমাজকর্মী মোল্লা গোলাম সরোয়ার, সাংবাদিক রহমান মুকুল, শাহ আলম মন্টু, আনোয়ার রশীদ সাগর, হামিদুল ইসলাম আজম ও আসিফ জাহান। পিন্টু রহমানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কহন কুদ্দুস, জামিরুল ইসলাম, তৈহিদুর রহমান, আক্তারুজ্জামান টুটুল, কানিজ তাসমিমা সরোয়ার, শাহরিয়ার জাহাঙ্গীর, রাজন, তানভীর আহমেদ সোহেল প্রমুখ।

এ সময় কবির জীবন কর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বক্তাগণ বলেন, শিল্পী জীবনের সীমিত পরিসরে নজরুলের বহুমুখি প্রতিভার মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ। তবে এ কথা বলা যায় প্রেম-দ্রোহ যার মনে-মননে এবং কবিতায় ফুটে উঠতে পারে, একই সাথে সে কবি মহাকবি না হয়ে কী পারেন! কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন ব্যক্তি জীবনে; কাজ করে গেছেন সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই। নজরুলের মানবসত্তা এবং তার বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ নজরুলকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের কবি অন্যতম। শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে। প্রেমের ক্ষেত্রে নজরুলের এই যে দ্বিমুখি বিদ্রোহ- এটা তার বিদ্রোহী চেতনাকে প্রাণবন্ত করার আরও একটি দিক। মূলত নজরুল বিদ্রোহ করেছেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, অবহেলিত সর্বোপরি দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জয়গান তিনি করেছেন সোচ্চারকণ্ঠে। যার কারণে তাকে সাম্যের কবি, মানবতার কবি বলা হয়। শরীরী পদচারণা না থাকলেও শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় আজও তার ‘উন্নত মম শির’। তাই কাজী নজরুল ইসলাম এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে।

ভ্রাম্যমা/কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসন ,কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদ, নজরুল স্মৃতি পাঠাগার, নজরুল সংগীত পরিষদ যৌথভাবে দিবসটি পালন করে। কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সদস্য কাওসার আলীর সভাপতিত্বে কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। বিশেষ অতিথি ছিলেন কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সদস্য আফাজ উদ্দিন মাষ্টার ও কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম । প্রধান আলোচক ছিলেন কার্পাসডাঙ্গা সাহিত্য সংসদের সভাপতি রবিউল হোসেন শুকলাল। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সদস্য কামরুজ্জামান রানা, শফি উদ্দিন এবং আব্দুল কাদের হিরক। আলোচনা শেষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং নজরুল গীতির আয়োজন করা হয়। নজরুল গীতি পরিবেশন করেন রঘুনাথ পাল। কবিতা আবৃত্তি করেন আফসানা মিমি। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন নজরুল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। অপরদিকে গত বুধবার বিকেল ৫টার দিকে সাইফুল ইসলামক নজরুল আন্দোলনের সাহসী যুদ্ধা ও এমএ ইব্রাহিমকে নজরুল গবেষক হিসেবে জাতীয় কবি সনম্মনা ২০১৫ অগ্নিবিনা কেন্দ্রীয় সংসদ ঢাকা ক্রেস্ট তুলে দেন সাবেক সাংস্কতিক সচিব রনজিৎ রায়।