ভূমিখাতে দুর্নীতি : ব্যবস্থা নেয়া জরুরি

 

দেশে ভূমি খাতে দুর্নীতির বিষয়টি সর্বজনবিদিত। যার সামান্য এক টুকরো জমি আছে, তিনি ওই জমিসংক্রান্ত কাগজপত্র বিধিসঙ্গত করাতে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হননি- এমন নজির বিরল। জমি নিবন্ধন, নামজারি, জরিপ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে জমির মালিককে দুর্নীতির শিকার হতে হয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ভূমি সেবায় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। ভূমি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেরাই দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রম: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে ভূমি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। উল্লেখ্য, টিআইবি ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত এ খাতে গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভূমিসংক্রান্ত যেকোনো সেবা পেতে মানুষকে ১০০ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি ঘুষের লেনদেন হয় জমি নিবন্ধন ও নামজারিতে। ভূমি জরিপের সময় জরিপকর্মী কর্তৃক জমির পরিমাণ কম দেখানো ও খতিয়ানে ভুল তথ্য লেখার ভয় দেখিয়ে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, ঘুষের বিনিময়ে খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত ও কোর্ট অব ওয়ার্ডসের সম্পত্তি দখলকারী ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের নামে রেকর্ড প্রস্তুত, তহসিল অফিস কর্তৃক ঘুষের বিনিময়ে নামজারির প্যাকেজ নির্ধারণ, কোনো কোনো ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধ দখলকৃত খাসজমি, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের এবং অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের নামে নামজারি, কৃষি খাসজমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের প্রভাব ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এসব অভিযোগের সত্যতার সাথে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। মানুষ তার কর্মসংক্রান্ত ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রায়ই এসব অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হন। এ বাস্তবতায় মানুষকে জমি সংক্রান্ত দুর্ভোগ, হয়রানি ও ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য ভূমি খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্তুত এ লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগও নিয়েছিলো। সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিলে আমরা একে স্বাগত জানিয়েছিলাম। এ উদ্যোগের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে ভূমি খাতে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যেতো। বিশেষত সারাদেশে জমির মৌজা ম্যাপ, খতিয়ান ও নামজারির খতিয়ান ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এলে এসব ক্ষেত্রে ঘুষের সুযোগ তিরোহিত হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের গতি অত্যন্ত মন্থর। সরকারকে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে টিআইবির তিনটি প্রধান সুপারিশ হলো- ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমিসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো পরিচালনার জন্য একটি একক অধিদফতর গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সামগ্রিক ভূমি ব্যবস্থাপনা, নিবন্ধন ও জরিপ ব্যবস্থায় সমন্বিত ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় বাজেটে ভূমি খাতের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে হবে। আমরা মনে করি, ভূমি খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারের উচিত এসব সুপারিশ আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশে জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ সীমিত। তাই জমি নিয়ে বিরোধ, সংঘর্ষ ও দুর্নীতিও এখানে বেশি। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে আগামীতে এসব আরও বাড়বে। তাই এ ব্যাপারে যতো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায় ততোই মঙ্গল।