জিএসপি সুবিধা স্থগিত পুনর্বহালে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন

 

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা নবায়ন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আবারো শ্রম অধিকার পর্যালোচনার কথা বলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শর্তাবলি যথাযথভাবে পূরণ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্থগিতাদেশ কেন প্রত্যাহার করা হয়নি তা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈকি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। জিএসপি সুবিধা ফিরে না পাওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক তো নয়ই, বরং গভীর উদ্বেগের বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশে শ্রম অধিকার রক্ষিত না হওয়া, কারখানার কর্মপরিবেশ শ্রমিকবান্ধব না হওয়া, শ্রমিকের জীবনও নিরাপত্তাহীন বাংলাদেশের শ্রম অধিকারসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবি দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডিতে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটি সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে আবেদন করে। ২০১৩ সালের ২৭ জুন ছয় মাসের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেশটি। বাস্তবতা হলো, জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর এ সুবিধা ফিরে পেতে সরকারকে শর্তারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সরকার কাজ শুরু করলে পরবর্তীতে দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধির নেতৃত্বে জিএসপি ইস্যুর পর্যালোচনায় গার্মেন্টস কারখানা ভবন ও অগ্নি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। এরপরও এ সুবিধা পুনর্বহাল না হওয়া অবমাননার বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এতে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পই হুমকির মুখে পড়বে না, একই সাথে ব্যাংক, বীমা ও নৌপরিবহনখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিএসপি সুবিধা না পেলে পোশাকশিল্প থেকে বিদেশি ক্রেতারাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। পাশাপাশি দেশের লাখ লাখ শ্রমিকও নিঃসন্দেহে বিপদগ্রস্ত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী যেখানে দাবি করেছেন, আমরা আমাদের শর্ত পূরণ করেছি সুতরাং জিএসপি সুবিধা কেন পুনর্বহাল হয়নি তা গুরুত্বসহকারেই খতিয়ে দেখা কর্তব্য। দেশের রপ্তানিমুখি শিল্পকারখানাগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তথ্যমতে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকখাত থেকে। ফলে জিএসপির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া সঙ্গত। বাণিজ্য সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে প্রায় পাঁচ হাজার পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি বাবদ বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ আসে জিএসপি সুবিধা থেকে। অনেকে মনে করেন জিএসপি সুবিধা না পেলে তা অর্থনীতির জন্য খুব একটা ক্ষতির নয়। কিন্তু মর্যাদার প্রশ্নে এ সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য দুঃখের বলেই আমরা মনে করি।

এটাও লক্ষণীয় যে, পোশাকশ্রমিকের জীবনমান ও অধিকার রক্ষায় সরকার এখন উদাসীন নয়। শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়নে সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণাসহ কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শর্ত পালন করে চলেছে সরকার। তবে এ কথাও সত্য, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ যখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। এখনো পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কর্মপরিবেশ পুরোপুরি নিশ্চিত ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ করে দেয়া যায়নি।

আমরা মনে করি, জিএসপি সুবিধা পেতে এসবের দিকেও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের সাথে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমমান বৃদ্ধিতে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। এরপরও বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বক্তব্য প্রমাণ করে, বাংলাদেশকে তারা বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে রাখতে চায়। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল না করে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এমনটিই বোঝাতে চায় যে, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড সন্তুষ্ট নয়। এ বিষয়টিও সরকারকে গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। জিএসপি পুনর্বহাল না হওয়া দেশের ভাবমূর্তির জন্য এক ধরনের সঙ্কট। সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার জিএসপি পুনর্বহালের ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।