আবারও নষ্ট গম খালাসের তোড়জোড় : পাল্টানো হচ্ছে নথিপত্র

ব্রাজিলের গম কেলেঙ্কারির রেশ না কাটতেই ফের আড়াই লাখ টন গম নিয়ে ভাসছে ৫ জাহাজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: ব্রাজিলের গম কেলেঙ্কারির রেশ না কাটতেই ফের নষ্ট গম খালাসের তোড়জোড় চলছে চট্টগ্রাম বন্দরে। অথচ দুটি জাহাজের গম মানসম্মত না হওয়ায় ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে খোদ খাদ্য অধিদফতর। তারপরও এসব গম ফেরত না নিয়ে বেসরকারিভাবে আমদানি দেখিয়ে বাংলাদেশের বাজারে সরবরাহ করতে নতুন কাগজপত্র তৈরি করা হচ্ছে। আবার আরেকটি জাহাজে ফ্রান্স থেকে আসা ৫২ হাজার টন নিম্নমানের গম আপত্তি থাকার পরও খালাসের উদ্দেশ্যে ভর্তি করা হয়েছে ১৪টি লাইটারেজ জাহাজে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে কোনো সময় লাইটারিং করা এসব গম খালাস হতে পারে। প্রায় আড়াই লাখ টন সরকারি গম বোঝাই পাঁচটি জাহাজ ভাসছে এখন চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে নিম্নমানের গম আছে তিনটি জাহাজেই।

লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের সংগঠন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ বলেন, সরকারের আপত্তি থাকার পরও ১৪টি লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া করে পিনটাইল নামক জাহাজ থেকে খালাস করা হয় গম। এসব গম খালাস করতে না পারায় দু মাস ধরে কর্ণফুলী নদীতে ভাসছে লাইটারেজগুলো। এ জন্য স্থানীয় শিপিং এজেন্ট থেকে
প্রায় দু কোটি টাকার পাওনা জমা হয়েছে আমাদের। তারা এ টাকা পরিশোধ করছে না, আবার নষ্ট গমও অন্যত্র বোঝাই করছে না। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার লাইটারেজ জাহাজ মালিকরা জরুরি বৈঠকে বসছেন বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল আজিজ মোল্লা বলেন, কিছু গমের মান চুক্তি অনুযায়ী না পাওয়ায় তা আমরা ফেরত দিয়েছি। কিছু গমের নমুনা নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। নষ্ট গম বাংলাদেশে খালাসের চেষ্টা করা হলেও আমরা সতর্ক আছি।

নষ্ট গম খালাসে ১৪ লাইটারেজ: বাংলাদেশে ব্রাজিলের গম নিয়ে জোর আলোচনার সময়ই গত ২১ মে ৫২ হাজার ৫০০ টন গম নিয়ে ফ্রান্স থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে এমভি পিনটাইল নামের একটি জাহাজ। মান নিম্ন হওয়ায় এ জাহাজের গম নিতে আপত্তি জানিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। অথচ এরই মধ্যে এ জাহাজ থেকে ৩০ হাজার ৮০০ টন গম খালাসের উদ্দেশ্যে ভর্তি করা হয়েছে ১৪টি লাইটারেজ জাহাজে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কো-কনভেনর খুরশিদ আলম বলেন, ৩০ হাজার ৮০০ টন গম বোঝাই ১৪টি জাহাজের ভাড়া না দিয়ে স্থানীয় শিপিং এজেন্ট লিপমন্ড আরও দুটি লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া চায় আমাদের থেকে। আমরা এসব গমের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত গম খালাস করতে নতুন করে কোনো লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ৩০ হাজার ৮০০ টন গমের মধ্যে সাত হাজার টন গম সরকারি সাইলোতে খালাস করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও ৫ জাহাজ সাগরে: পিনটাইলের মতো রোমানিয়া থেকে স্পারকেনিজ জাহাজটি ৫১ হাজার ৩৪৭ টন গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে ২ জুন। একই দিন আর্জেন্টিনা থেকে ৫০ হাজার ৯৪৭ টন গম নিয়ে আসে আরেকটি জাহাজ গ্রিনফনিক্স। রোমানিয়া থেকে ৫০ হাজার ১৪৮ টন গম নিয়ে এমভি জিনইয়াও জাহাজ এসেছে ১৪ জুন। ফ্রান্স থেকে ৫১ হাজার ৬৫৯ টন সরকারি গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ মে এসেছে এমভি টিয়ানজিন ভেনসার নামে আরেকটি জাহাজ। নিম্নমানের গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে শান্তা ক্যাটারিনা ও অ্যালবাট্রস নামে আরও দুটি জাহাজ। ব্রাজিল থেকে সাড়ে ৫২ হাজার টন গম নিয়ে শান্তা ক্যাটারিনা চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে গত ১২ জুন। আর ফ্রান্স থেকে সাড়ে ৫২ হাজার টন নিম্নমানের গম নিয়ে অ্যালবাট্রস বহির্নোঙরে ভিড়েছে গত ৯ জুলাই।

নানা অভিযোগে পিনটাইল, স্পারকেনিজ ও জিনইয়াও জাহাজের গম ভাসছে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে। গ্রিনফনিক্স ও টিয়ানজিন ভেনসারে থাকা এক লাখ টন গম খালাস হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। কিন্তু শান্তা ক্যাটারিনা ও অ্যালবাট্রস নামের দুটি জাহাজে থাকা গম নিম্নমানের হওয়ায় তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় খাদ্য অধিদপ্তর। কিন্তু কাগজপত্র পরিবর্তন করে শান্তা ক্যাটারিনা জাহাজে থাকা গম বেসরকারিভাবে আমদানি দেখিয়ে খালাস করার চেষ্টা চলছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে আবেদনও করেছে এ দুটি জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট।
গম খালাসে পাল্টানো হচ্ছে নথিপত্র: খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদ ইতোপূর্বে জানান, মানোত্তীর্ণ না হওয়ায় ও অসম্পূর্ণ কাগজপত্র থাকায় শান্তা ক্যাটারিনা ও অ্যালবাট্রসের গম গ্রহণ না করে তা ফেরত পাঠাতে বলেছি। চুক্তি অনুযায়ী তাদের সমপরিমাণ ভালো গম সরবরাহ করতে হবে। জানা গেছে, এ দুটি জাহাজে আমদানি করা গমে বিনষ্ট (ক্ষতিগ্রস্ত ) দানার পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী এমন দানার পরিমাণ মোট গমের ৪ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এ জন্য গত ১৪ জুলাই সরবরাহকারীকে চিঠি দিয়ে এসব গম গ্রহণে অস্বীকৃতির কথা জানিয়ে দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি গমবাহী জাহাজকে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগেরও ছাড়পত্র দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু এসব গম ফেরত না নিয়ে তা বেসরকারিভাবে আমদানি দেখিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আবেদন করা হয়েছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ আবেদনে এখনও সাড়া দেয়নি।
বাংলাদেশে এসব গম সরবরাহ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান গ্রেন কোর ও এগ্রো কর্প। ব্রাজিলের গম সরবরাহকারী নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রেন কোর-এর দেশীয় এজেন্ট ইমপেক্স লিমিটেড। আর পিনটাইল, গ্রিনফনিক্স ও স্পারকেনিজ জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট লিপমন্ড শিপিং।
সরকারি গম নিয়ে আসা তিনটি জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট লিপমন্ড শিপিংয়ের অন্যতম স্বত্বাধিকারী বেলায়েত হোসেন বলেন, সরকারি গম নিয়ে আসা তিনটি জাহাজের মধ্যে গ্রিনফনিক্স জাহাজটি গম খালাস করে ফেরত গেছে। পিনটাইল জাহাজের গম খালাস করা যাবে কি-না তা জানতে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়েছি আমরা। খালাসের উদ্দেশ্যে পিনটাইল থেকে ৩০ হাজার ৮০০ টন গম লাইটার জাহাজে ভর্তি করার পর সাত হাজার টন গম সাইলোতে খালাসও করেছি আমরা। এর পরই আসে আপত্তি। এ জন্য লাইটার করা গমগুলোও আমরা খালাস করতে পারছি না। আবার স্পারকেনিজ জাহাজে থাকা ৫০ হাজার টন গম খালাসের জন্যও পাচ্ছি না লাইটারেজ। আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক শেষে এ গমের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।