বুকের ধন কোলে তুলে নিতে পারলেন না মা

 

মাতৃগর্ভে বুলেটবিদ্ধ শিশু আইসিইউতে ও মা ভর্তি গাইনি ওয়ার্ডে

স্টাফ রিপোর্টার: লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেও সন্তানকে বুকে তুলে নিতে পারলেন না মা। একই হাসপাতালে, একই ছাদের নিচে, তবু দেখা হয়নি মা-সন্তানের। আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে তাদের। মাতৃগর্ভেই বুলেটবিদ্ধ হয়ে জন্ম নেয়া শিশুটি অবিরাম লড়ে চলেছে মৃত্যুর সাথে। নানা উপসর্গ দেখা দেয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এমন সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে রাতে মাগুরা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে শিশুর হতভাগ্য মা নাজমা বেগমকে। মায়ের বুকের দুধ ও স্পর্শের জাদু সন্তানকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগাবে বলে আশা চিকিৎসকদের। কিন্তু মাগুরা থেকে ঢাকা পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রাপথের ধকল সামলে উঠে হাসপাতালে পৌঁছুলেও আইসিইউতে ঢুকে নাড়িছেঁড়া ধনকে কোলে তুলে নিতে পারেননি মা নাজমা বেগম। ঢামেক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে এখন তার নিজেরই চিকিৎসা চলছে। কখন দেখা হবে মা-মেয়ের তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চিকিৎসকরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় মাগুরা সদর হাসপাতাল থেকে একটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে নাজমা বেগমকে ঢাকায় পাঠানো হয়। মাগুরা সদর হাসপাতালের সার্জারি কানসালটেন্ট ডা. সফিউর রহমান জানান, নাজমা বেগম এখন সম্পূর্ণ আশংকামুক্ত। তবে তারও ফলোআপ চিকিৎসা প্রয়োজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৫ মিনিটের দিকে ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছেন গুলিবিদ্ধ শিশুর মা নাজমা বেগম ও বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া। হাসপাতালে পৌঁছেই তারা তাদের সন্তানকে দেখতে চান। কিন্তু দায়িত্বরত চিকিৎসক শিশুটিকে তখনই তাদের দেখার অনুমতি দেননি। রাত ৯টার দিকে কেবল বাবাকে আইসিইউতে ঢুকতে দেয়া হয়। বেরিয়ে এসে বাচ্চু জানান, তিনি দেখেছেন তার সন্তান ঘুমিয়ে আছে। চিকিৎসকরা জানান, মাগুরা থেকে ঢাকা পর্যন্ত লম্বা রাস্তা পাড়ি দেয়ার ধকল সামলাতে পারেননি নাজমা বেগম। তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গাইনি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নার্সরা মোবাইলে তোলা সন্তানের ছবি দেখিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাকে। যেখানে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, শিশুটির জন্য মায়ের বুকের দুধ খুবই জরুরি। এ তথ্যটি নাড়া দিয়েছে অন্য মায়েদের। শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাসপাতালে আসেন নবজাতক শিশুদের অনেক মা। কোনো কোনো স্বামী তাদের স্ত্রীর বুকের দুধ কৌটায় করেও নিয়ে এসেছেন। কেউ আবার এসেছেন শিশুটির চিকিৎসায় আর্থিক সাহায্য দেয়ার জন্য।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢামেকের এনআইসিইউ ও নবজাতক ওয়ার্ড নিওনেটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ ছোট্ট শিশুটিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। শিশুটির জ্বর ও জন্ডিস রয়েছে। একটি স্বাভাবিক নবজাতক শিশুর ওজনের চেয়ে তার ওজন প্রায় অর্ধেক। ছোট্ট এই শরীরটিতেই ৪টি স্থানে ২১টি সেলাই রয়েছে। শিশুটিকে কোনো প্রকারেই শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। তার বয়সে একটি শিশুর রক্তে প্লাটিলেট দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ পর্যন্ত থাকার কথা। এ শিশুর প্লাটিলেট ৫০ হাজারে নেমে এসেছে।

বুলেটবিদ্ধ এ কন্যাশিশুর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ও শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলী জানান, বুধবার শিশুটির ৪টি ক্ষতস্থানে অস্ত্রোপচার করা হয়। বুলেটটি তার পিঠের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বুক, হাত, গলা ও চোখ ভেদ করে। অস্ত্রোপচারের পর শিশুটিকে শিশু সার্জারি ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছিলো। ওই রাতে তার অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার সকালে বোর্ডের নির্দেশে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। অসময়ে কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুদের স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় এ শিশুটির ঝুঁকি অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নবজাতক শিশুর মায়েরা আসছেন। কোনো কোনো স্বামী তার স্ত্রীর বুকের দুধ কৌটায় নিয়ে এসেছেন। তবে শিশুটিকে এখন পর্যন্ত শুধু স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।

শিশুটির ফুফু শিখা আক্তার জানান, সকাল থেকে ৫-৬ জন এসেছেন মায়ের বুকের দুধ নিয়ে। কেউ এসেছেন সরাসরি বুকের দুধ খাওয়াতে। ডাক্তার কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। মন খারাপ করে চলে যেতে হয়েছে তাদের। রাজধানীর শান্তিবাগ থেকে আসা মশিউর রহমান দুধের কৌটা হাতে নিয়ে ২১১ নম্বর ওয়ার্ডের পাশে কাঁদছিলেন। জানালেন, শিশুটির খবর জানার পর থেকে তার স্ত্রী নূরজাহান জেরিন হাসপাতালে ছুটে আসতে চাচ্ছেন। আফনান আয়ান নামক তিন মাসের একটি শিশুসন্তান রয়েছে তাদের। স্ত্রীর বুকের দুধ কৌটায় করে নিয়ে এসেছেন। যখন শুনলেন, শিশুটির অবস্থা ভালো না, দুধ খেতে পারছে না তখন তিনি খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। মিরপুর থেকে আসা সাইফুল ইসলাম স্ত্রীর বুকের দুধ কৌটায় ভরে নিয়ে এসেছেন। জানালেন, বাসায় এক মাসের কম বয়সী শিশুকে রেখে স্ত্রী হাসপাতালে আসতে পারছেন না বলে তার কাছে কৌটায় ভরে বুকের দুধ দিয়ে দিয়েছেন। সাইফুল বলেন, মায়ের মমতা যে কী তা তিনি তার স্ত্রীর ব্যাকুলতা দেখে বুঝতে পেরেছেন। তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ শিশুটির জন্য স্ত্রীর দেয়া দুধ নিয়ে এসেছেন।

ব্যাংকার সুমি আহসান হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছিলেন। সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন শিশুটির দু ফুফুকে। চিকিৎসকদের কাছে বারবার অনুরোধ করে বলছিলেন, তিনি শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে এসেছেন। সুমি জানান, তার একটি ছোট বাচ্চা রয়েছে। তিনি পেশায় ব্যাংকার। হাসপাতালে ছুটে এসেছেন নাজমা বেগমের মেয়েকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেই এমন অনেক মা এসেছেন হাসপাতালে। কৌটায় স্ত্রীর বুকের দুধ নিয়ে এসেছেন অনেক স্বামী।

এদিকে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও আসামিদের শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার মাগুরা শহরের আদর্শ কলেজ এলাকায় মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আদর্শপাড়া, দরিমাগুরা ও দোয়ারপাড় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন।

উল্লেখ্য, ২৩ জুলাই বৃহস্পতিবার মাগুরা শহরের দোয়াপাড়ায় দলীয় আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় যুবলীগের দু গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত স্থানীয় যুবলীগ নেতা আলী হোসেনের গ্রুপ দরিদ্র বাচ্চু ভূঁইয়ার বাড়িতে ত্রাস সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।

ওই সময় বাচ্চু ভূঁইয়ার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা বেগমের পেটে গুলি লাগে। শনিবার রাতে মাগুরা সদর হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচারে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন গুলিবিদ্ধ নাজমা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দেখা যায়, নবজাতকও মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ভোররাতের দিকে গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।