জেলা প্রশাসকদের সৃজনশীল হওয়ার তাগিদ : ২১ বিষয়ে নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর

স্টাফ রিপোর্টার: জেলা প্রশাসনে এতদিন ছিলো জেলা প্রশাসক (ডিসি)-পুলিশ সুপার (এসপি) দ্বন্দ্ব। দীর্ঘদিনের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সদস্যরা ডিসির ডাকে সাড়া দেন না। এখন এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে জেলা পর্যায়ের কাস্টমস, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। এমনকি জেলা কৃষি কর্মকর্তারাও ডিসিদের কথা শোনেন না। জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তারা উপস্থিত হন না। ফলে বিভিন্ন সেক্টরের নানা অবস্থা সম্পর্কে অনেক সময় অন্ধকারে থাকেন ডিসিরা। এতে করে নানা ধরনের সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়। ডিসি সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে মুক্ত আলোচনায় এবং সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে এমন সব অভিযোগ করেন ডিসিরা। তারা বলেন, কেউ শোনে না তাদের কথা। তাই আগামীতে জেলা পর্যায়ের এই সমন্বয়হীনতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন ডিসিরা। একাধিক ডিসি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে আলাপ করে এমন তথ্য জানা গেছে।

এদিকে একুশটি বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার তাগিদ দিয়ে পুরনো ধ্যান-ধারণা বদলে জেলা প্রশাসকদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সাথে তিনি বলেন, রুটিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রতিটি জেলায় কি ধরনের নতুন কাজ হাতে নেয়া যায়, যা ওই জেলার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে,  সেই ধরনের নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করা, কৌশল নির্ধারণ করা এবং বাস্তবায়ন করার দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। মঙ্গলবার তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা যে জনগণ ও সরকারের মধ্যে  সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছেন, সে কথাও তাদের মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। দেশের সব জেলার প্রশাসকদের নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের তিন দিনের এই সম্মেলনের উদ্বোধন হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যায়ের শাপলা হলে। জেলা প্রশাসকরা ছাড়াও মন্ত্রী পরিষদের সদস্য এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে জেলা প্রশাসনের জন্ম হলেও বর্তমানে কালের বিবর্তনে আজ সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে এই দেশ পরিচালনা করব, উন্নত করব এবং এগিয়ে নিয়ে যাবো সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। কাজেই পুরনো ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, একটি জেলার সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে জেলা প্রশাসনের কর্মীদের ওপর। ভূমি ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন পরিচালনা, ভেজালবিরোধী অভিযান, পরিবেশের সুরক্ষা, বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কর্তন রোধ, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচির বাস্তবায়নের মত কাজগুলো তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। তবে এসব রুটিন কাজের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের সৃজনশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একেক অঞ্চলের একেকরকম বিশেষত্ব রয়েছে। ফলে কোন এলাকার জন্য কী পদক্ষেপ নিলে সে এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নত হতে পারে সে ধরনের বিশেষ দিকগুলো একটু খুঁজে বের করতে হবে।
সব ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে আইনের আওতায় দায়িত্ব পালন করতে জেলা প্রশাসদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাষ্ট্র তথা জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণই হবে আপনাদের মূল লক্ষ্য। সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে।

চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে নাশকতা দমনে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক সমস্যা থেকে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা আরও কঠিন ছিল। সেগুলো আপনারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। আপনারা সক্রিয় ছিলেন বলেই এ ধরনের অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কাজ কেউ করতে না পারে সে বিষয়েও সজাগ থাকার নির্দেশ দেন তিনি।

শেখ হাসিনা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ,  যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য-প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের তথ্য-উপাত্ত ডিসিদের সামনে তুলে ধরেন। লক্ষ্যমাত্রার আগেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রত্যয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের আগে যেন মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে পারি সে লক্ষ্য নিয়েই সকলকে আরও দ্রুত কাজ করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে এবং সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতেও ডিসিদের নির্দেশ দেন তিনি। সর্বশেষ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের ২১টি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন।

নির্দেশনাগুলো হলো- ১. সরকারি সেবা গ্রহণে কেউ যেন হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয়;
২. নারী ও শিশু নির্যাতন, পাচার ও মাদক দ্রব্যের অপব্যবহারসহ যৌতুক ও বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে; ৩. প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে; ৪. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় মাঝারি শিল্পের বিকাশে ব্যবস্থা নিতে হবে; ৫. জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে সহায়তা করতে হবে; ৬. তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সাথে এক হয়ে কাজ করতে হবে; ৭. নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার কমানো এবং ঝরে পড়াদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ৮. ভূমি শাসন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে; ৯. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ১০. ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে; ১১. পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলি অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ১৩. সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে; ১৪. জেলা প্রশাসকেরা জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটিকে আরো সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করতে হবে; ১৫. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; ১৬. শিল্পাঞ্চলের শান্তিরক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রফতানি নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৭. ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো প্রচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে; ১৮. নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১৯. শিশুকিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০. কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান এবং এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে;  ২১. পার্বত্য জেলাগুলোর ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে রংপুর বিভাগ এবং কুষ্টিয়া, পঞ্চগড় ও নারায়ণগঞ্জ জেলাকে ডিজিটাল সেবা পুরস্কার দেওয়া হয়। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ও তিন জেলার ডিসি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেন।