বাড়ছে অসংক্রামক রোগ

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে অসংক্রামক রোগ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। দেড় দশকের ব্যবধানে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং আর্থ্রাইটিসের মতো অসংক্রামক ব্যাধি কয়েক গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনে বিস্তার ঘটছে এসবের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা ইত্যাদি অসংক্রামক রোগ বাংলাদেশে বেড়ে যাচ্ছে। মূলত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে এসব রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোমল পানীয়, প্যাকেটজাত জুস, অ্যানার্জি ড্রিংক্স ও ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড সেবন, ধূমপান ও শাদাপাতা-গুল-জর্দাসহ চর্বনযোগ্য তামাক সেবন, সব রকম মাদক সেবন মানুষকে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ করে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিবিএস জরিপে দেখা গেছে, দেশের মানুষের সর্বাধিক আক্রান্ত ১০টি রোগের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জ্বর। প্রতি হাজারে ১৯ দশমিক ১০ জন জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এরপরই ধারাবাহিকভাবে রয়েছে আলসার, বাত, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বক্ষব্যাধি, আমাশয়, হৃদরোগ এবং চোখের ছানি। সর্বশেষ স্বাস্থ্য ও রোগ জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দুই বছরের ব্যবধানে আর্থ্রাইটিসে প্রতি হাজারে ১৪ থেকে ১৭ দশমিক ১৬ জনে, ডায়াবেটিসে ৭ দশমিক ৮ জন থেকে ১০ দশমিক ৫১ জনে, হৃদরোগে ৩ দশমিক ৩ জন থেকে ৬ দশমিক ৫৯ জন এবং ক্যান্সারে দশমিক ছয় থেকে দশমিক ৭১ জন আক্রান্ত হয়েছে। ২০০০ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭ জন, ২ দশমিক ৭ জন, ১ দশমিক ৬ জন এবং দশমিক ৪ জন।

আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কর্মব্যস্ত জীবনে পরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পরিবর্তে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট, ফাস্টফুড, জাঙ্কফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়াই অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। ফলে ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মোটাজনিত রোগ বাড়ছে। বাংলাদেশের ২০ বছরের বেশি বয়সী গ্রামের মানুষের মাঝে ৭ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৭ দশমিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ২ শতাংশ মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসের কারণে। এছাড়া খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, সচেতনতা কম এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে অপুষ্টিতে ভুগছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে কায়িক শ্রম না করায় একটি বড় অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ১৮-এর বেশি বয়সীদের শতকরা ১৩ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে পুরুষ ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারী ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তাছাড়া দেশের মোট মৃত্যুর শতকরা ২ দশমিক ৪ ভাগ হার্ট অ্যাটাকে, ৩ দশমিক ৬ ভাগ স্ট্রোক এবং ৬ দশমিক ৫ ভাগ অন্যান্য হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ সর্বমোট ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ নানাবিধ হৃদরোগ। ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে দেশে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগ। দেশের জনগণের প্রতি হাজারে যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের ৪৫ ও ২২ জনের হাঁপানিবহির্ভূত শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত। তথ্য অনুযায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগের কারণে মৃত্যুর পরিমাণ মোট মৃত্যুর ৩ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রামাঞ্চলের ৪৩ শতাংশ ও শহরের ৯০ শতাংশ অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলেও শহরাঞ্চলের মানুষ চাহিদার ৫৮ শতাংশ অধিক শর্করা ও ১৬ শতাংশ অধিক চর্বি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৩ ভাগ মহিলা বিপাকীয় উপসর্গ বা মেটাবলিক সিনড্রোমে ভোগেন। বাংলাদেশে ২০ ঊর্ধ্ব গ্রামের মহিলাদের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরের মহিলা ও পুরুষদের যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৩১ শতাংশ ওজনাধিক্যজনিত সমস্যায় ভোগেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. টিটু মিয়া বলেন, প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ এ ধরনের রোগে মারা গেলেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়েনি। সচেতনতা বাড়াতে পারলে এ থেকে নিরাপদে থাকা সম্ভব। চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকেই প্রাধান্য দিতে হবে। ডা. টিটু আরও বলেন, এক সময় মনে করা হতো, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধযোগ্য নয়, প্রকৃতপক্ষে শতকরা ৮০ শতাংশ অপরিণত হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস এবং ৪০ ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। তিনি বলেন, নিয়মিত হাঁটা, খেলাধুলা, ব্যায়াম ও সাইকেল চালানোর মাধ্যমে স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে শহরে হাঁটা ও সাইকেল চালানোর উপযোগী পরিবেশ থাকা দরকার। এছাড়া শিশুদের জন্য খেলার মাঠ, পার্কের স্থানগুলো সব শহরে রাখতে হবে। পুষ্টিকর খাবার এবং শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক রোগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, অসংক্রামক ব্যাধিতে প্রাপ্তবয়স্করাই আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এতে একজন উৎপাদনশীল মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে অথবা মৃত্যুবরণ করে, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায়। তিনি বলেন, শুধু সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব। যেহেতু এ ধরনের রোগগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তাই ব্যক্তিকেই সচেতন হতে হবে।