সাঈদী ও মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায়

স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিলের রায়ে সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ১০ মাস আগে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ রায় দেন; কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি এখনো। একইভাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন গত ১৬ জুন। মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ও প্রকাশিত হয়নি। দুটি আপিলেরই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কত দিনের মধ্যে কোনো মামলা নিষ্পত্তি করবেন কিংবা কতো দিনে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করবেন সে বিষয়ে কোনো সময়সীমার বাধ্যবাধকতা নেই। এটি একান্তই আপিল বিভাগের এখতিয়ার। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করে আপিল দাখিল করার দিন থেকে ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার বিধান যুক্ত করা হয়। তবে এই সময়সীমা মানা আপিল বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা-সংক্রান্ত আপিল ছাড়াও আরো নানা ধরনের মামলা চলে। এ অবস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা-সংক্রান্ত আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি এবং এর পূর্ণাঙ্গ রায় দ্রুত প্রকাশের জন্য আপিল বিভাগে বিশেষ বেঞ্চ কিংবা ট্রাইব্যুনালের ভেতরেই আলাদা আপিল ট্রাইব্যুনাল বা আপিল চেম্বার গঠন করা দরকার বলে মনে করেন অনেক আইনজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-আন্দোলনের সংগঠকরা।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, এসব মামলাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর আবেগ। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছি, আপিল বিভাগে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন থাকায় এসব মামলার চাপের সাথে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা যেন মিলিয়ে দেখা না হয়। ট্রাইব্যুনাল থেকে আসা মামলা অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষভাবে দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যথায় ট্রাইব্যুনালের ভেতরেই আপিলের ব্যবস্থা করে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ জন্য আইন সংশোধনসহ যা কিছু করার তা সরকারকেই করতে হবে। এ দাবি আমরা অনেক দিন ধরেই করে আসছি।’ সাঈদী ও মুজাহিদের মামলায় দ্রুততার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আপিল বিভাগে অনেক মামলা। এর পরও মানবতাবিরোধী মামলা অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে সময় লাগছে- এটা সত্য। তবে কত দিনের মধ্যে রায় দিতে হবে এর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম বা আইন নেই। রায় নিয়ে যাতে কেউ কোনো পশ্ন তুলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাড়াহুড়ো করে রায় দিতে গিয়ে যদি ভুল থেকে যায় তবে তা নিয়ে সমালোচনা হবে, প্রশ্ন উঠবে। আপিল বিভাগের রায় নিয়ে যাতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন উঠতে না পারে সে জন্য হয়তো দেশের সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রায় দেওয়ার জন্যই সময় নিচ্ছেন।

এই আইনজ্ঞ আরো বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশের বিচার অনেক মানসম্পন্ন। এ বিচার নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করার বিধান রাখা হয়েছে। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিচারে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে আর তা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে তখন আপিল বিভাগে সেটা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এ রকম আপিল করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় দিচ্ছেন। এমনকি আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার মামলায় রিভিউ করার সুযোগ দিয়েছেন। অপরাপর মামলায়ও কত দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

সাঈদীর আপিলের রায় দেওয়ার পর আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলায় চূড়ান্ত রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের করা আপিল নিষ্পত্তি করে গত বছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর করা রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি শেষে গত ১১ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এরপর মুজাহিদের আপিলের রায় দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের শুনানি শেষে আগামী ২৯ জুলাই রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

সাঈদী ও মুজাহিদের মামলায় আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, শিগগিরই মুজাহিদের রায় প্রকাশিত হবে বলে আশা করছি। গত বছর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সাঈদীর মামলায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে ওই রায় দেওয়া হয়। তখনকার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের (বর্তমানে অবসরে) নেতৃত্বে এ বেঞ্চের সদস্য ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনালে বিচারে সাঈদীর বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয় পাঁচটি। ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত তিনটি অভিযোগ থেকে আপিল বিভাগ সাঈদীকে খালাস দেন। আপিল বিভাগ প্রমাণিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড, একটিতে ১২ বছরের ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে আপিল বিভাগের রায়ে কী কারণে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তা জানা যায়নি। আর কোনো তিনটি অভিযোগের দায় থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়েছে, তাও জানা যায়নি। রায় প্রকাশ করার পর এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এসব জানার কোনো সুযোগ নেই।

ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এক রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আটটি অভিযোগে সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এসবের মধ্যে দুটি অভিযোগে (ইব্রাহিম কুট্টি ও বিশাবালীকে হত্যা) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অন্য ছয়টিতে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, যেহেতু দুটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো, তাই অন্য প্রমাণিত অপরাধে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া ১২টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তা থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়।

মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল: একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে তখনকার আলবদর বাহিনীর প্রধান জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে গত ১৬ জুন রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগ মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ একটিতে (শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা) মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় দেন। ওই বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই এক রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের উত্থাপিত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় সেগুলোতে সাজা দেয়া হয়। ওই পাঁচ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন মুজাহিদ। এসবের মধ্যে চারটি অভিযোগ আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে ষষ্ঠ অভিযোগে (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড) মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া সপ্তম অভিযোগে (বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়ন) ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছেন। তৃতীয় অভিযোগে (ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে আটক রেখে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং পঞ্চম অভিযোগে (নাখালপাড়া সেনাক্যাম্পে আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, আজাদ, জুয়েলকে নির্যাতন ও পরে হত্যা) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। প্রথম অভিযোগ (সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন অপহরণ ও হত্যা) থেকে মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগটি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের সঙ্গে মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন মুজাহিদকে।