মেহেরপুরের গাংনী বামন্দী-কাজিপুর সড়কের সাহেবনগর তালতলা নামক স্থানে বিপত্তি : ঘটনাস্থল থেকে দু বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধার
মাজেদুল হক মানিক: মাইক্রোবাস তল্লাশির সময় দুর্বৃত্তদের ফিল্মিস্টাইলে আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার পীরতলা ক্যাম্পের পুলিশ কনস্টেবল আলা উদ্দীন। গতরাত পৌনে আটটার দিকে বামন্দী-কাজিপুর সড়কের সাহেবনগর তালতলা নামক স্থানে মাইক্রোবাস তল্লাশিকালে তিনি দুর্বৃত্তদের হামলায় মারাত্মক জখম হন। তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। গতকাল শুক্রবার রাত ১০টার দিকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
নিহত আলা উদ্দীন গাংনী উপজেলার পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিশাকুণ্ডির মৃত রতন আলীর ছেলে। মাইক্রোবাস থেকে ফেলে যাওয়া দু বস্তা ফেনসিডিল রাতেই ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
স্থানীয় ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, পীরতলা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সুবির বিশ্বাসের নেতৃত্বে কনস্টেবল আলা উদ্দীন ও একজন আনছার সদস্য সাহেবনগর তালতলা মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় কাজিপুরের দিক থেকে একটি শাদা রঙের মাইক্রোবাস পুলিশ টহল এলাকা অতিক্রম করার সময় পুলিশ সদস্যরা থামতে নির্দেশ দেন। মাইক্রোবাসের গতি কমলে পুলিশ সদস্যরা মাইক্রোবাসটি তল্লাশি করার চেষ্টা করে। এ সময় মাইক্রোবাসটি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গেলে আলা উদ্দীন সামনে পড়েন। মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে জাপটে ধরে। মাইক্রোবাসের সাথে লাগোয়া অবস্থায় তাকে টেনেহেঁচড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে হাড়াভাঙ্গা মাদরাসার কাছে ফেলে পালিয়ে যায় মাইক্রোবাসটি। এ সময় স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় আলা উদ্দীনকে উদ্ধার করেন। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এএসআই সুবিরসহ সঙ্গীয় পুলিশ সদস্যরা। মুমূর্ষু অবস্থায় আলা উদ্দীনকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত দশটার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে জেলা পুলিশ বিভাগ ও পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। আলা উদ্দীনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে নাকি আঘাত করা হয়েছে তা নিয়ে স্থানীয় লোকজন ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করে।
মেহেরপুর পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, মাইক্রোবাসে ফেনসিডিল পাচার হচ্ছে মর্মে খবর পেয়ে এএসআই সুবির সঙ্গীয় দুজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে সড়কে গাছ ফেলে অবস্থান করছিলেন। মাইক্রোবাসটি অতিক্রম করার সময় আলা উদ্দীনকে মাইক্রোবাসের সাথে আটকে দেয় নেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় সড়কের সাথে ঘষা লেগে আলা উদ্দীন গুরুতর আহত হন। বিপদ বুঝতে পেরে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থলের কাছেই দু বস্তা ফেনসিডিল ফেলে পালিয়ে যায়। পরে বস্তা দুটি থেকে ৩৪০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আলাউদ্দিনের মৃত্যু হয় বলে জানান চিকিৎসকরা। এদিকে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার খবরে তোলপাড় শুরু হয় জেলা পুলিশ বিভাগে। তিনটি থানা, সকল পুলিশ ক্যাম্প ও পুলিশের টহল দলের সদস্যরা যার যার অবস্থান থেকে সড়কে অভিযান শুরু করে। কিন্তু গতরাত দুটোর দিকে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন জানান, খবর পেয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিক চেকপোস্ট বসানো হয়। তবে বৃষ্টির কারণে সড়কে মানুষ চলাচল কম থাকায় মাইক্রোবাসটি পালিয়ে গেছে। দ্রুত মাইক্রোবাসসহ দুর্বৃত্তদের আটক করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান মেহেরপুর পুলিশ সুপার হামিদুল আলাম ও গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেনসহ পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ। অভিযানে অংশ নেয়া দুজনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। শোকে মুহ্যমান পুলিশ সুপারসহ পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ সহকর্মী হারানোর বেদনা নিয়েই তদন্ত ও আটক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা ২৪ ঘণ্টা মানুষের নিরাপত্তা দানে নিয়োজিত সেই পুলিশ সদস্যের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। যেকোনো মূল্যে মাইক্রোবাসসহ হত্যাকারীদের আটকের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানান মেহেরপুর জেলা পুলিশ। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলা উদ্দীনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে যান কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারসহ পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ। আহত ছেলের খবর পেয়ে মা মর্জিনা খাতুন ও স্বজনরাও ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুর খবর যেন বজ্রপাতের মতোই বিধে স্বজনদের বুকে। বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন মা। তাদের বুকফাটা কান্নায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ। নিহতের মরদেহ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত শেষে আজ মেহেরপুর আনা হবে। আজ দুপুরের কোনো এক সময় জানাজা শেষে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে খুলনা রেঞ্জে কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেন আলা উদ্দীন। সেখান থেকে গত বছরের ৪ এপ্রিল মেহেরপুর জেলায় বদলি হন। পরবর্তীতে তিনি গাংনী উপজেলার পীরতলা পুলিশ ক্যাম্পে আসেন। নিজ গ্রাম থেকে পীরতলা পুলিশ ক্যাম্পের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় স্বজনদের সাথেই তার স্ত্রী বসবাস করতেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের কোনো সন্তান হয়নি।