স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় পেট্রোল বোমা হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে খালেদা জিয়া ও তার সহযোগীদের বিচারে সরকারের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী তার টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তরে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য সেলিনা বেগমের এক প্রশ্নের জবাবে একথা জানান।
এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেট্রোল বোমা হামলার নির্দেশদানকারী খালেদা জিয়া ও তার সহযোগীসহ সকল অপরাধীর নামে দায়েরকৃত মামলাগুলো বিচার করার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯ এর ২৭ ধারা অনুযায়ী সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে। ভবিষ্যতে উক্ত আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। গত ২ জুন শবেবরাতের রাতে কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনাও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। একই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, উক্ত ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ আইনের অধীন অপরাধীদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার জন্য দায়রা জজ বা দায়রা জজ কর্তৃক অতিরিক্ত দায়রা জজকে বিচারকার্য সম্পন্ন করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
তিনি জানান, বিএনপি-জামায়াত জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার হুকুমে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে হরতাল-অবরোধে পেট্রোল বোমা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে মোট ১৩৪ জনকে হত্যা করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের ইস্যুবিহীন কথিত আন্দোলনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে ১ হাজার ৩৯৫টি যানবাহনে, ১৩ দফায় ট্রেনে এবং ৬ দফা লঞ্চে নাশকতা চালানো হয়।
বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে প্রথম সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ওই অধ্যাদেশকে আইনে রূপ দেয়। ওই সরকারের মেয়াদপূর্তির আগে ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনও করা হয়। তবে এর ২৭ ধারা অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে সন্ত্রাসী ও মদদদাতাদের বিচার করার উদ্যোগ এর আগে কখনো নেয়া হয়নি।
পেট্রোল বোমা নিয়ে খালেদা জিয়া মিথ্যাচার করছেন: অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী ইফতার পার্টিতে বসে মিথ্যা বলে যাচ্ছেন, অন্যকে অপবাদ দিচ্ছেন। সবাই জানে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছিলো বিএনপি-জামায়াত। তারা পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মেরেছে। আর এখন বলছে পুলিশ নাকি এসব পেট্রোল বোমা মেরেছে। উনি এসব কীভাবে বলেন! পবিত্র রমজানে বিএনপি নেত্রীর এই ধরনের মিথ্যাচার দেখে তাজ্জব হয়ে যাই।
চলতি দশম জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ অধিবেশন গতকাল শেষ হয়েছে। গত ১ জুন শুরু হয়ে ২৬ কার্যদিবসের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া অধিবেশনটি ছিলো বাজেট অধিবেশন। এটি ছিলো বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় বাজেট। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেটের ওপর এবার সংসদে ৫৮ ঘণ্টা সাধারণ আলোচনা হয়। এই অধিবেশনে মোট পাঁচটি বিল পাস হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশন সমাপ্তি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আদেশ পড়ে শোনান। উল্লেখ্য, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৪টা ৩৮ মিনিট পর্যন্ত টানা প্রায় সোয়া ৬ ঘণ্টা অধিবেশন চলে, এতে টানা সভাপতিত্ব করেন শিরীন শারমিন। এই বিরল রেকর্ডের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে ধন্যবাদও জানান।
সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও সরকার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অন্যবারের চেয়ে এবার প্রায় চারগুণ বড় আকারের বাজেট দেয়া হয়েছে। এই বাজেটও আমরা বাস্তবায়ন করবো, এজন্য সকলের সহযোগিতা চাই। ইনশাল্লাহ, আগামী ৩ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তখন কিছু মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষদিকেও জ্বালাও-পোড়ায়ের মাধ্যমে ব্যাপক জুলুম চালানো হয়েছিল। তারা নির্বাচনে না এসে কতো প্রাণ নিয়েছে। এবারও টানা ৯৩ দিন ধরে জ্বালাও-পোড়াও করেছে।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত: অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গতকাল সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। টাঙ্গাইল-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের আনা এ ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর প্রায় ৩০ জন সদস্য দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেন।
নিম্ন-মধ্যম থাকতে চাই না, কারও কাছে হাত পাততে চাই না: ওই ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থাকতে চাই না। বাংলাদেশ এই জায়গায় থাকবে না। উন্নত দেশ হিসেবে থাকতে চাই। কারও কাছে হাত পেতে চলতে চাই না। ভিক্ষা করে যেন চলতে না হয়। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে দাঁড়াতে চাই। এরমধ্যেও অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে। ৭৫’র ১৫ আগস্ট হত্যার পর ২১ বছর উন্নয়নের চাকা সামনে এগোয়নি। মানুষ এদেশকে চিনতো ঘূর্ণিঝড় আর দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে, তখন আমাদের ভিক্ষা করে চলতে হতো। তবে এবার মানুষ জ্বালাও-পোড়াওয়ে সাড়া দেয়নি, বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। এই অর্জন ধরে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে: ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে, তখন শুধু মধ্যম আয়ের দেশ থাকবে না, আমরা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ডিজিটাল সবকিছুই উন্নত হবে।
২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর শত জন্মবার্ষিকী উদযাপন: ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-শতবার্ষিকী উদযাপন করবো। জাতির পিতা যেই দেশ স্বাধীন করে গেছেন, তখন তার আত্মা শান্তি পাবে। তিনি তখন দেখবেন তার দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, দেশে বসেই বিদেশের উপার্জন করছে।
এমপিদের এলাকায় যেতে বললেন প্রধানমন্ত্রী: বিকেল ৪টা ৩৮ মিনিটের দিকে অধিবেশন শেষে প্রধানমন্ত্রী যখন অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হচ্ছিলেন, তখন তাকে বিদায় জানাতে আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্য সেখানে জড়ো হন। এ সময় তাদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায় এখন তো আর অধিবেশন নেই, যাও এলাকায় চলে যাও, তাদের সথে ঈদ করো, মানুষের পাশে থাকো।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন শিগগিরই: এদিকে ওয়াসিকা আয়শা খানের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা সংসদকে জানান, বাংলাদেশ ও ভারত দু দেশের সীমান্ত চুক্তির বিধানগুলো শিগগিরই বাস্তবায়ন করবে। সীমান্ত চুক্তির ফলে দু দেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হবে। দু দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমারেখা সুনির্দিষ্ট হবে। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তির ফলে অপদখলীয় ভূমি সংক্রান্ত ও অচিহ্নিত সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
আয়েন উদ্দিনের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা সংসদকে জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টিতে মানবিক দিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যতদ্রুত সম্ভব সম্পাদনের আশ্বাস দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির (জাপা) নূরুল ইসলাম ওমরের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক ও কলা-কুশলীদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠনের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন গণমাধ্যম সহায়ক নীতিমালা ২০১৫’র খসড়া চূড়ান্ত করে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।