ঝরা পাতার কষ্টে পোড়া করুণ চিত্র

জীবনের শেষ দিনগুলোতেও আপনজনদের কাছে পেলেন না বৃদ্ধ জলিল মণ্ডল

 

DSC09386

স্টাফ রিপোর্টার: ভিক্ষে করে গচ্ছিত টাকা সপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে যে মেয়ে এসে নিয়ে যেতো, ৫ দিন ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পড়ে থাকলেও সেই মেয়ের একবারের জন্যও পিতাকে দেখতে আসতে দেখা যায়নি। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় ভিক্ষুক জলিল মণ্ডল মারা গেলে হাসপাতালে কর্তব্যরতদের অনেকেই এ মন্তব্য করে বলেছেন, হাসপাতালে সকলেই আসেন চিকিৎসা নিতে। তিনি এসেছিলেন ভিক্ষে করতে। দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করে স্ত্রী-সন্তানের আহার জোগালেও জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাদের কাউকেই কাছে পেলেন না তিনি।

আলমডাঙ্গার পল্লি বড় গাংনীর শিবপুর গ্রামের আব্দুল জলিল মণ্ডল কয়েক বছর ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মূল দরজার অদূরে দাঁড়িয়ে রোগী ও রোগীর লোকজনের নিকট হাত পাততেন। ভিক্ষে করতে আসা বৃদ্ধ বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। ৫ দিন ধরে অবস্থা ছিলো গুরুতর। গতকাল রোববার ইফতারির কয়েক মিনিট আগেই হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। গতরাতেই তার মৃতদেহ শিবপুরের কয়েকজন নিজ গ্রামের উদ্দেশে নেন। তাদের মধ্যে সপ্তায় সপ্তায় টাকা নিতে আসা সেই ছোট মেয়েকে না দেখে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, হায়রে দুনিয়া! স্ত্রী না এলেও লাশ গ্রহণের সময় এক ব্যক্তি নিজেকে বৃদ্ধ জলিলের শ্যালক বলে পরিচয় দেন। তিনি জানান, বেশ কিছুদিন ধরে জলিলের স্ত্রী ও মেয়ে নতিডাঙ্গা আবাসনে বসবাস করে আসছে। মেয়ে মিনার স্বামী রাশিদুল ওই আবাসনেরই বাসিন্দা। তার নেশার টাকা জোগাতেই ভিক্ষুক পিতার নিকট থেকে সপ্তায় সপ্তায় টাকা নিয়ে আসতো মিনা। এরকমই তথ্য পাওয়া গেছে।

আব্দুল জলিল ঠিক কবে থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে ভিক্ষের জন্য হাত পাতেন তার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ তেমন কেউ বলতে না পারলেও তিনি মূলত আলোচিত হন নেশাখোর ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। তাকে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই দাদা বলে ডেকে এক নেশাখোর কৌশলে পাঞ্জাবির পকেটে থাকা টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। ওই সময় হাসপাতাল চত্বরের কলপাড়ে গোসল করছিলেন তিনি। গোসলে সহযোগিতার অজুহাতে কাছে গিয়ে দাদা বলে ডেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নেশাখোর প্রতারক পালালে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ফার্মেসি মালিক মানিকুজ্জামান মানিক কিছু আর্থিক সহযোগিতা করে বৃদ্ধ আব্দুল জলিলের কান্না থামান। সেই থেকে আব্দুল জলিল কোথায় ঘুমোচ্ছে, কোথায় থাকছে সেদিকে নজর রাখতেন মানিকসহ অনেকে। বৃদ্ধকে যারা নজরে রাখতেন তারাই বলেছেন, প্রতিদিন চেনা লাঠিটা আখড়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ভিক্ষে করতেন। ভিক্ষের গচ্ছিত টাকা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার মেয়ে এসে নিয়ে যেতো। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন আব্দুল জলিল। এক চিকিৎসক বলেছেন, মাস খানেক আগে পড়ে হাত ভেঙে অসুস্থ অবস্থায়ও হাসপাতালেই ছিলেন। হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েও তিনি মাঝে মাঝে ইমার্জেন্সির সামনে ভিক্ষের হাত পাততেন। গত ৫ দিন ধরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সেই টাকা নিতে আসা মেয়েকে পিতার খোঁজ নিতে যেমন দেখা যায়নি, তেমনই একাই হাসপাতালের এক কোণে পড়ে থেকে অবশেষে গতকাল মারা গেলেন তিনি। মারা যাওয়ার পর দাফনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতে অনেকে আগ্রহী হলেও কেউই নগদ দিতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, যে সন্তান বৃদ্ধের ভিক্ষে করা টাকা নিয়ে আর পিতার খোঁজ রাখেনি, তাদের হাতে আবারও টাকা? সে কারণে কয়েকজন বিশেষ উদ্যোগী হয়ে কাফনের কাপড় কিনে দেন বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা বলেছেন, জলিলের স্ত্রীও মাঝে মাঝে টাকা নেয়ার জন্য আসতেন। এলাকার কয়েকজন বলেছেন, আব্দুল জলিল এক সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি সেখান থেকে এসে শিবপুরে বিয়ে করে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস শুরু করেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মিস্ত্রির কাজে তার সুনামও ছিলো। কাজ করতে গিয়েই বিধি বাম। পড়ে তিনি আহত হন। চিকিৎসা নিতে দীর্ঘ সময় কাটে। এরপর আর রাজমিস্ত্রির কাজে ফেরা সম্ভব হয়নি তার। অবশেষে তিনি ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নেন। রাজমিস্ত্রি থেকে ঝরে পড়ে নিজেকে কষ্টে পুড়িয়ে তিনি ধুপের মতো নিকটজনদের মাঝে গন্ধ বিলিয়েও পেলেন কি জীবনের অর্থ?

মারা যাওয়ার পর বৃদ্ধ জলিল মণ্ডলের নিকট পাওয়া গেছে দুটি পাউরুটি, এক টুকরো কেক, এক বোতল পানি, একটা কলা। টাকা? ৫শ ৫০ টাকা ছিলো। লাশ গ্রহণকারীদের নিকট এ টাকাসহ দাফন কাফনের জন্য নগদ আরো কিছু দেয়া হয় বলে জানা গেছে।