রোজা ও ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বড় অংশই যাচ্ছে দৈনন্দিন খরচ ও ভোগবিলাসে!

স্টাফ রিপোর্টার: রোজা ও ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বড় অংশই যাচ্ছে দৈনন্দিন খরচ ও ভোগবিলাসে। এ সময় বাড়তি খরচ মেটাতে প্রবাসীরা দেশে অবস্থানরত তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বেশি পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকেন। যে কারণে অন্য সময়ের তুলনায় রোজা বা ঈদের সময় বেড়ে যায় রেমিটেন্সের প্রবাহ। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডি ও নগদ আকারেও প্রচুর রেমিটেন্স আসে। ফলে ব্যাংকগুলো এ সময় রেমিটেন্সের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে পারে না।

রোজায় রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে, এরই মধ্যে রিজার্ভ আড়াই হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। রেমিটেন্সের প্রভাবে বাড়ছে টাকার প্রবাহ। এতে বাজারে বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে। এই চাহিদা মেটাতে পণ্য উৎপাদকরা বেশি বিনিয়োগ করছেন। বাড়ছে কর্মসংস্থান। সার্বিকভাবে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের আয়ের ৮৩ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ভোগবিলাসে। তাদের মোট রেমিটেন্সের মধ্যে ৭৪.৬৮ শতাংশই কোনো উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ হয় না। বাকি ২৫.৩২ শতাংশ অর্থ পরোক্ষভাবে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় জমি বা ফ্ল্যাট কেনায়। বাকি অর্থ অন্যান্য খাতে।

গত দু অর্থবছর ধরে প্রতি বছর গড়ে দেশে রেমিটেন্স আসছে ১ হাজার ৪৩২ কোটি ডলার। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী মোট রেমিটেন্সের মধ্যে ১ হাজার ৬০ কোটি ডলারই বিনিয়োগ হয় না। এগুলো খাদ্য, শিক্ষা ও ভোগবিলাসে খরচ করা হয়। বাকি ৩৭২ কোটি ডলার রেমিটেন্স বিনিয়োগ হয় বিভিন্ন খাতে। এর মধ্যে মাত্র ২৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলার বিনিয়োগ করা হয় জমি ও ফ্ল্যাট কেনায়। বাকিটা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ হয়।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদের সময় বেশি রেমিটেন্স আসে। এর প্রায় ৯০ ভাগই ব্যয় করা হয় ভোগবিলাসে। অন্য সময় হয়তো বিলাসিতায় খরচ কিছুটা কম হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের রেমিটেন্স যদি উৎপাদন খাতে ব্যবহার করা যেতো, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে অনেক দ্রুত পরিবর্তন আসতো। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। সরকারিভাবে বন্ড ছেড়ে কিছু রেমিটেন্স সংগ্রহ করা হয়, এটাও সরকার উৎপাদন খাতে খরচ করতে পারছে না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, প্রবাসীদের রেমিটেন্সের বিপরীতে ভালো মুনাফা দিয়ে একটি ফান্ড গঠন করে তা থেকে উদ্যোক্তাদের উৎপাদনমুখি খাতে ঋণ দেয়া যেতে পারে। এ ঋণের বিপরীতে শর্ত থাকবে কোম্পানি চালুর এক বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে যেতে হবে। এর মধ্যে থেকে প্রবাসীদের শেয়ার দিতে হবে। গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্য সময়ের তুলনায় ঈদের সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রায় ৫ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ঈদের পরের মাসে আবার তা কমে আসে। সারা বছর প্রবাসীরা যে রেমিটেন্স পাঠান তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠান রোজা ও ঈদের সময়। ২০১২ সালের ২০ জুলাই থেকে শুরু হয় রোজা। রোজা শুরুর আগের মাসে জুনে রেমিটেন্স এসেছিল ১০৭ কোটি ডলার। রোজার শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে রেমিটেন্স এসেছিল ১২০ কোটি ১২ লাখ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রেমিটেন্স বেড়েছে ১৩ কোটি ১২ লাখ ডলার। এর পরের মাসে আগস্টে তা আবার কমে দাঁড়ায় ১১৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।

২০১৩ সালে রোজা শুরু হয় ৯ জুলাই। ওই বছরের জুনে রেমিটেন্স এসেছিলো ১০৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার। রোজার শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে রেমিটেন্স এসেছিলো ১২৩ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এ মাসে রেমিটেন্স বেড়েছিলো প্রায় ১৮ কোটি ডলার। তার পরের মাসে অর্থাৎ আগস্টে তা কমে ১০০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারে দাঁড়ায়।

একই অবস্থা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছরে রোজা শুরু হয়েছিল ৩০ জুন। রোজা শুরুর আগে মে’তে রেমিটেন্স এসেছিলো ১২১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। জুনে এসেছিলো ১২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। জুলাইয়জুড়ে ছিলো রোজা। ফলে এ মাসে রেমিটেন্স এসেছিলো ১৪৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার। ওই মাসে রেমিটেন্স বেড়েছিলো ২০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। পরের মাসে অর্থাৎ আগস্টে রেমিটেন্স আবার কমে দাঁড়িয়েছিলো ১১৭ কোটি ৪৪ লাখ ডলারে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক হিসাবে ভারসাম্য রাখছে। একে কোনোক্রমেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। এর পরিকল্পিত ব্যবহার বাড়লে আমাদের অর্থনীতি আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরেও রোজা ও ঈদের কারণে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়ে যাবে। এ বছর রোজা শুরু হয়েছে ১৯ জুন থেকে। রোজা শুরুর আগে অর্থাৎ মে’তে রেমিটেন্স এসেছিলো ১৩১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। চলতি মাসের ১৯ জুন পর্যন্ত রেমিটেন্স এসেছে ৯৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। মাস শেষে এর পরিমাণ বেড়ে গত মাসের চেয়ে বেশি হতে পারে। এছাড়া রোজা ও ঈদের প্রভাবে আগামী মাসেও রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকবে।

রেমিটেন্সের এই হিসাব হচ্ছে শুধু ব্যাংকিং খাতের। এর বাইরে হুন্ডি ও নগদ আকারে আরও রেমিটেন্স আসছে। যার পরিমাণ ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বেশি। কেননা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, রেমিটেন্সের ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে, বাকি ৩০ শতাংশ হুন্ডিতে এবং অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ নগদ আকারে। এসব রেমিটেন্স মিলে ঈদের সময় অর্থনীতিতে টাকার বেশ একটি জোরদার প্রবাহ থাকে।

রেমিটেন্সের বড় অংশই আসছে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে। ৭ বছর ধরে সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে অনেক কর্মী চলে এসেছে। তারপরও ওই দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেনি। এখনও সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সৌদি আরব থেকে। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৩০২ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখান থেকে এসেছে ২৫৮ কোটি ডলার। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই দেশ থেকে এসেছে ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ডলার। চতুর্থ অবস্থানে আছে মালয়েশিয়া। সেখান থেকে এসেছে ১২৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার। বাকি রেমিটেন্স এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।

ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স সংগ্রহ করে ইসলামী ব্যাংক। তারা গত মে পর্যন্ত তারা সংগ্রহ করেছে ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মিলে সংগ্রহ করেছে ১৯ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।