অভাব ঘোচাতে হাতের কাজ : কাটছে এখন ব্যস্ত সময়

স্বনির্ভরতা অর্জনে ঘরে বাইরে থেমে নেই নারী সমাজের অগ্রযাত্রা

 

খাইরুজ্জামান সেতু/আলম আশরাফ/সাইফ জাহান: স্বনির্ভরতা অর্জনে ঘরে বাইরে নারী সমাজের অগ্রযাত্রা গ্রামবাংলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অভাব তাড়ানোর যুদ্ধে তথা উপার্জনের সংগ্রামে মনের বল আর স্বামীর সহযোগিতা বদলে দিচ্ছে সংসারের ছবি। অল্প শিক্ষিত নারীরা তাদের হাতের কাজের মাধ্যমে প্রতিভা পল্লবিতয় অন্যদেরও উৎসাহিত করছে নিজের অজান্তেই। কেমন? কাপড় কেটে সেলাই করে নারী-পুরুষের পোশাক তৈরির কাজে নিয়োজিতরা তারই খণ্ডাংশ।

চুয়াডাঙ্গায় এক সময় পোশাক তৈরির দোকান তথা টেইলার্সে নারী শ্রমিক দেখলে অপ্রগতিশীলদের অনেকেই নাক সিটকাতেন। সমবায় নিউ মার্কেটে মিতা টেইলার্স নামের প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে যখন এক নারী নিজেকে সামনে দাঁড় করালেন, তখন অবশ্যই এখনকার মতো অতোটা সহজ ছিলো না। এই তো দেড়-দু যুগ আগের ছবি ছিলো সেটা। নারীসমাজের এগিয়ে চলা বহু আগে থেকে শুরু হলেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার প্রতিটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লাতেই রয়েছে নারী টেইলার্স। পরিচালক নারী, শ্রমিকও নারী। গ্রামের ঘরে ঘরে এরকম নারী টেইলার্সের সংখ্যা চুয়াডাঙ্গায় কতোটি? পরিসংখ্যান না থাকলেও জেলা শহরের পুরাতন গলির ভেতরের কাঁইচি ধার দেয়া তথা শান দেয়া ঘরের স্বত্বাধিকারী রতন সাহার দেয়া তথ্যমতে কয়েক হাজার। প্রতিদিনই তার শানঘরে নারী দর্জিদের কাঁইচি শান দিতে ভিড় জমান অনেকে। ভিড় বাড়ে ঈদ মরসুমে। এবারও ঈদ মরসুমে ভিড় বেড়েছে তবে গতকাল পর্যন্ত লাইন পড়েনি। কারণ, বৃষ্টি। গতকাল রতন সাহার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। প্রতিবছরই নারী দর্জির সংখ্যা বাড়ছে। রোজার আগে সেলাইমেশিনের দোকানেও বেড়ে যায় বেচাবিক্রি। মেশিন মেরামতের দোকানেও লাগে ভিড়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের গুলশানপাড়ার শাহিনুর পারভীন আগে নিজের বাড়িতেই পোশাক তৈরির কাজ করতেন। দিন দিন কাজ বেড়েছে, বেড়েছে আয়। বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে নারী খদ্দেরের সাথে পুরুষের গৃহে প্রবেশ দৃষ্টিকটুর কারণে পরবর্তীতে তিনি পলাশপাড়া মোড়ে দিয়েছেন দোকান। এটা যেমন শহরের অধিকাংশ মহল্লার চেনা ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনই গ্রামবাংলার পাড়ায় পাড়ায় নারী দর্জির সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। এতে কাস্টমার কমেছে? না। মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে কাজের চাপ। দরকার শুধু মনের জোর নিয়ে কাজ শিখে নিজের মেধার বিকাশ ঘটানো। জাফরপুরের কয়েকজন নারী দর্জির সাথে কথা হয় তাদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়ে। তাদের অধিকাংশের অভিন্ন অভিমত, সংসারের অভাব ঘোচাতে শুধু স্বামীর ওপর নির্ভর করে থাকলে কি চলে? ঘরে বসে সংসারের খুনসুটির পাশাপাশি যদি সেলাইয়ের কাজ করে আয় করা যায় তা দোষের কি? এ থেকেই তো শুরু। দিন দিন কাজ বাড়ছে, বাড়ছে আয়। বদলে যাচ্ছে সংসারের আসবাবপত্র, আভিজাত্যও আসে। সন্তানের আবদার না মেটাতে পারার কষ্টেও মুখ লুকিয়ে গুমরে কাঁদতেও হচ্ছে না। আর অনেক নারীই আছেন যাদের পরিবারের একজন সদস্যের পোশাকও বাইরে দিতে হয় না। নিজেই তৈরি করে সাশ্রয় করেন খরচ।

শুধু কি স্বামীর সংসারে? নেশাখোর স্বামীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর অসংখ্য নারী অভিন্ন কাজে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছেন। পিতার বাড়ি থাকলেও পিতা, ভাই-ভাবীর মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। এদের অনেকেই অবশ্য নিজেদের পরিচয় দিয়ে পাত্রস্থ হতে অনাগ্রহী। বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তাদেরও আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে দর্জির কাজ। এতে শহরের জমজমাট বিপণি বিতানে বড় বড় নামকরা টেইলার্সের ব্যবসায় ভাটা পড়ছে না? এ প্রশ্নের জবাব জানতে গত দুদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের বেশ কয়েকটি মার্কেটের বড় বড় টেইলার্সে টেইলার্সমাস্টারের সাথে কথা হয়। তারা বলেছেন, যতোই তৈরি পোশাকের কদর বাড়ুক, গ্রামবাংলায় ঘরে ঘরে যতোই দর্জির সংখ্যা বেড়ে যাক তাতে শহরের বড় বড় টেইলার্সে মোটেই বিরূপ প্রভাব পড়ছে না। বরঞ্চ কাজ বেড়েই চলেছে। এবার রোজার শুরু থেকেই কাজের চাপ টেইলার্স মালিকদের উৎসাহিত করে আসছে। শ্রমিকদেরও যেন ঘুম নেই।

চুয়াডাঙ্গার বড় বড় টেইলার্সে একটি জামা তৈরির মজুরি আড়াইশ থেকে ২শ ৬০ টাকা। প্যান্ট তৈরির মজুরি সাড়ে তিনশ থেকে ৩শ ৬০ টাকা। কোর্ট? আড়াই হাজারের যুগ গত হয়েছে। এখন কম করে হলেও তিন হাজার। সাফারি এক হাজার থেকে দেড় হাজার। মেয়েদের থ্রিপিস দেড়শ থেকে দুশো। অবশ্য অধিকাংশ টেইলার্সেই ১৮০ টাকা মজুরি। পাঞ্জাবি তৈরির মজুরি দুশো। পাজামা ৮০ থেকে ১শ। শহরতলী ও গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নারী পরিচালিত টেইলার্সে পুরুষদের পোশাকের বদলে ছোট বড় মেয়েদের পোশাকই বেশি তৈরি হয়। মজুরিও আনুপাতিক হারে অনেক কম।