সারাদেশে বেপরোয়া জালটাকার অর্ধশত চক্র

স্টাফ রিপোর্টার: বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জালটাকা কারবারীদের চক্র। ঈদকে সামনে রেখে মাঠে নেমেছে তারা। ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে জালটাকার নোট। চিনতে না পেরে জালনোট নিয়ে কখনও প্রতারিত হচ্ছেন বিক্রেতা কিংবা ক্রেতারা।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত অর্ধশত জালটাকা তৈরির চক্র রয়েছে। এদের অনেককেই গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলেও মাস যেতে না যেতেই তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। ফিরে যায় আগের পেশায়। রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে গোয়েন্দা পুলিশও জালটাকা তৈরির চক্রগুলোকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারে অভিযানে নেমেছে। ইতিমধ্যে প্রায় কোটি টাকার জাল নোটসহ ১২ কারবারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে জালটাকার কারাবারীরা বাজারে জালনোট ছাড়ার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে তালিকা ধরে জালটাকার কারবারীদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত অর্ধশত জালনোট তৈরির চক্র সক্রিয় রয়েছে। একেকটি চক্রে সাধারণাত ৩-৫ জন সদস্য থাকে। একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার ও টাকা তৈরির নকশা নিয়েই এরা ‘কাজে’ নেমে পড়ে। এরপর বিশেষ এজেন্টের মাধ্যমে এসব জালটাকা ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে ছড়িয়ে দেয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জালনোট তৈরি চক্রের সদস্যরা নিজের পারিবারিক বাসার বাইরেও একাধিক বাসা ভাড়া নেয়। সেই বাসা মূলত ব্যবহার করা হয়ে থাকে জালটাকা তৈরির জন্য। আবার কেউ বুঝে ফেলতে পারে ২-৩ মাসের বেশি একই এলাকায় অবস্থানও করে না।

জালটাকা তৈরির অভিযোগে বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃতরা আদালত থেকে সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। তারা অর্থের বিনিময়ে বড় বড় আইনজীবীদের ঠিক করে রাখে। এ কারণে জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসার পরপরই এলাকা বদলিয়ে আবারও আগের ব্যবসায় নেমে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের তালিকা অনুযায়ী জালটাকা তৈরির চক্রগুলোর মধ্যে ছগীর মাস্টারের চক্রটি বেপরোয়া। ছগির মাস্টার একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও সে জামিনে বেরিয়ে এসে জালটাকার ব্যবসা করছে। এখন যারা সারাদেশে জালটাকার ব্যবসায় সক্রিয় তারা এক সময় ছগীর মাস্টারের চক্রের সদস্য ছিলো। গোয়েন্দা পুলিশের একটি তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে জালটাকার সক্রিয় ব্যবসায়ীরা হলো মাহবুব মোল্লা, বাদশা, নজীর, রশিদ, মোক্তার, সিরাজ, বাবু, ইমন, মনির খান, ইয়াকুব ফকির, রুবেল গাজী, সাহাবুদ্দিন, নাজমুল ইসলাম, ফয়সাল হোসেন ওরফে বাবু, আবু তালেব, মোহাম্মদ হোসেন, আমজাদ হোসেন নূপুর, সালাম শেখ, নজরুল ইসলাম নজু, শহীদুল ইসলাম শহীদ, শফিকুল ইসলাম শামীম, সোহাগ অধিকারী, সুমন আহম্মেদ, বায়েজীদ, সিদ্দিকুর রহমান, জেসমিন আক্তার, পলাশ, হুমায়ূন, জামান, রহিম, মাজহারুল ইসলাম, হাওলাদার সোহেল, আলামীন, আরিফ আরমান ওরফে নিপু, শফিকুল ইসলাম, সোহেল মিয়া, হাফিন গাজী, শিহাব, রাজু, হামিদুর, রহমান, লেলিন মিয়া ও মৃণাল। এ তালিকার অনেককেই বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তারা আবার জামিনে বেরিয়ে এসে জালটাকার ব্যবসায় নেমেছে। তালিকার অল্প কয়েকজন এখনও কারাগারে বন্দি রয়েছে। ডিবি’র সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি বলেন, একটি চক্রের সদস্যরা ‘কাজ’ শেখা শেষে নিজেরাই একেকটি চক্র গড়ে তোলে। আবার গ্রেফতারের পর জেল থেকেও সহজেই ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় পুরোনো পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এজন্য ধারাবাহিক অভিযানে জালনোট চক্রগুলোকে ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। মাঝে-মধ্যেই একেকটি চক্রকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।

জালটাকার কারবারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ে বিপাকের মধ্যেই আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বারবার এসব কারবারীর গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক-ফোকরের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলাতেও জামিন পেয়ে যাচ্ছে জালটাকার কারবারীরা। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জালটাকা তৈরির অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৮০ শতাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে আগের পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এসব চক্রের এক সদস্যের সাথে অপর চক্রের সদস্যদের যোগাযোগ থাকে। এ কারণে একজন কেউ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে অন্যরা তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য নিজের অর্থ খরচ করে। জেল থেকে বেরিয়ে তা পরিশোধ করা হয়। এসব চক্রের রয়েছে নির্দিষ্ট আইনজীবী প্যানেল। গ্রেফতারের পরপরই আইনজীবীদের জানিয়ে দেয়া হয়। এরা অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে জামিনের বন্দোবস্ত করে দেয়। জালটাকার কারবারীরা সর্বোচ্চ ২-৩ মাস কারাগারে আটক থাকে।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে কামরাঙ্গীচর থানায় ৩টি, গুলশানে ১টি, মিরপুর মডেল থানায় ৩টি, বংশাল থানায় ১টি, সবুজবাগ থানায় ১টি, ভাটারা থানায় ১টি, রমনা মডেল থানায় ২টি, শেরেবাংলা নগর থানায় ৩টিসহ জালনোট চক্রের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মোট ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সময়ে মধ্যে এ চক্রের ৫৩ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগই জামিনে রয়েছে।

জালনোট চক্রের কেউ গ্রেফতার হলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। পুলিশ এসব মামলায় যাদের সাক্ষী করে প্রায়শই তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। ফলে মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে। জালনোট প্রতিরোধে ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ অপরাধের সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠায়। এছাড়া জালনোট ব্যবসায় জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেও শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু জালনোটে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সুপারিশের বিরোধিতা করা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। এরপর সেই সুপারিশ আর আলোর মুখ দেখেনি।

জালনোট  তৈরির পর তিন ধাপে তা ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। চক্রের সদস্যরা জালনোট তৈরির পর তা এজেন্টদের কাছে প্রতি লাখের বান্ডিল ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। এজেন্টরা এসব নোট সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। এজেন্টরা এসব মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের কাছে তা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় লাখ টাকার বান্ডিল বিক্রি করে। মাঠ পর্যায়ের কারবারীরা শহরের বিপণিবিতান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বা গ্রামের হাট-বাজারে একটি একটি করে নোট বাজারে ছেড়ে দেয়। এটাকে তারা ঝুঁকিমুক্ত বলেও মনে করে। কারণ জালনোটের মাঠ পর্যায়ের কারবারীরা সাধারণাত একটির বেশি নোট একত্রে বহন করে না। জালনোট দিয়ে কেউ ধরা পড়লে তা নিজেরাই ‘ঠকেছে’ ভাব দেখিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারারা জানান, জালটাকার কারবারীদের কাছে দু ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে কোনও উৎসবের আগে ঢাকাসহ সারাদেশেই কেনাকাটার ধুম লেগে যায়। এ সময় জালটাকা ছড়িয়ে দেয়ার মোক্ষম সময় হিসেবে গণ্য করে তারা।