নিজ গাড়িতে যাওয়া যাবে ভারত-নেপাল ও ভূটান

স্টাফ রিপোর্টার: উপআঞ্চলিক কানেকটিভিটি জোরদারে নতুন এক ধাপ অগ্রগতি সাধন করল চার দেশ। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে সড়ক পথে যাত্রীবাহী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচলে চুক্তি হয়েছে। গতকাল সোমবার ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চার দেশের সড়ক পরিবহনমন্ত্রীরা চুক্তিতে সই করেন। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তির আওতায় চার দেশের মধ্যে আগামী বছর থেকে যান চলাচল শুরু হওয়ার কথা। এর আগে চলতি বছরের অক্টোবরে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে যান চলাচল। মূলত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষ্যেই এ চুক্তি। থিম্পুতে যে চুক্তি হয়েছে তা কাঠামোগত চুক্তি। এরপর প্রায়োগিক দিকগুলো নিয়ে আরেকটি চুক্তি ও প্রটোকল হবে। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার দিকে চার দেশের মন্ত্রীরা সড়ক পরিবহনের একটি রূপরেখা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মোটরযান চুক্তিটির প্রথম প্রস্তাব ছিলো দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের আওতায়। কিন্তু পাকিস্তান এ চুক্তিতে আপত্তি তোলায় এটি উপআঞ্চলিক চুক্তি হিসেবে চার দেশের মধ্যে সই হলো। ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এ চুক্তিতে যুক্ত হতে পারবে বলে জানা গেছে। তবে চুক্তিবদ্ধ চার দেশের কোনো এক দেশ আপত্তি জানালে তা আটকে যাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছে, যেখানে তৃতীয় দেশে পণ্য চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছে। যানবাহন চলাচলে চার জাতির চুক্তি হওয়ায় কানেকটিভিটি জোরদার হবে।
এর আগে ‘বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে যাত্রী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটরযান চুক্তি’ নিয়ে রোববার থিম্পুতে পরিবহন সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। ভুটানের তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী লিনোপো ডি এন ধুঙ্গিয়েল, ভারতের সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক ও নৌপরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়করি এবং নেপালের ভৌত অবকাঠামো ও পরিবহনমন্ত্রী বিমলেন্দ্র নিধি চুক্তিতে সই করেন। অনুষ্ঠানে যোগ দেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েনচাই ঝ্যাং। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, আজ আমরা আঞ্চলিক সংযোগের এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে একত্রিত হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, এ চুক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যাত্রী চলাচল, মালামাল পরিবহন এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে।’ চুক্তির পর এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, চার দেশের মধ্যে মোটরযান চলাচলের এ চুক্তিটি বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কার্যকর সব পরিবহন চুক্তি ও ব্যবস্থাগুলোর সম্পূরক হবে, যেগুলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব পক্ষ মেনে চলবে। এ চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো জটিলতা দেখা দিলে ‘বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল) মোটরযান চলাচল চুক্তির বিধান অনুযায়ী তা নিষ্পত্তি করা হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, চার দেশের মধ্যে এ উদ্যোগের অধীনে উপআঞ্চলিক সংযোগ এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্র ও সুবিধাগুলো তুলে ধরতে অক্টোবরে বিবিআইএন ফ্রেন্ডশিপ মোটর ৱ্যালি আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ কর্মপরিকল্পনা পর্যবেক্ষণে জাতীয় স্থল পরিবহন ত্বরান্বিতকরণ কমিটিগুলোর (নোডাল) কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নের গতিতে কোনো সমস্যা উদ্ভূত হলে তা দ্রুত নজরে আনতে বলা হয়েছে। চার দেশের মধ্যে আন্তঃসংযোগ ত্বরান্বিত করতে দক্ষিণ এশীয় উপআঞ্চলিক অর্থনৈতিক (সাসেক) কর্মসূচি বাস্তবায়নে এডিবির সহায়তা করছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
গত ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে যানবাহন চলাচলে ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট (এমভিএ)’ সইয়ের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা সাংবাদিকদের জানান, চুক্তির প্রস্তাবে চার দেশের সম্মতিতে ভবিষ্যতে এই সড়ক পথে অন্য যে কোনো দেশের যুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তিন বছর পরপর এই চুক্তি নবায়ন হবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কোনো দেশ চাইলে ৬ মাসের নোটিশ দিয়ে চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পাররে।’ ১৫ জুন চুক্তি ও পরে প্রটোকল সই হওয়ার পর শিগগিরই চুক্তি অনুযায়ী যানবাহন চলাচল শুরু হবে বলে জানান তিনি। এর আগে এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপের আদলে এ চার দেশের মধ্যে ২০১৬ সালে মোটরযান চলাচল শুরু করা যাবে।
চুক্তি অনুযায়ী চার দেশের মধ্যে চলাচলে রুট পারমিট নিতে হবে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার সময় মাঝপথে কোনো যাত্রী বা মালামাল তোলা যাবে না। যে দেশের ওপর দিয়ে যানবাহন যাবে, সেই দেশের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তা ‘সার্চ’ ও ‘ইন্সপেকশন’ করতে পারবে। কোনো দেশে নিষিদ্ধ থাকা পণ্য সেদেশের ওপর দিয়ে পরিবহন করা যাবে না বলেও চুক্তিতে রয়েছে। চুক্তির আওতায় যান চলাচলের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ নিজেদের নির্ধারিত হারে ‘ট্রানজিট ফি’ আদায় করবে বলে জানান তিনি। চুক্তি সই হওয়ার পর এর প্রটোকলে নিরাপত্তাসহ বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রটোকল হতে কয়েক মাস লাগবে। আশা করছি, ২০১৬ সালে আমরা নতুন যাত্রা শুরু করতে পারব। যাতায়াতে ভিসা বা ইমিগ্রেশনে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হবে।’
যেভাবে বাস্তবায়ন হবে: অক্টোবরের মধ্যে চুক্তির পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন এবং আগস্টের মধ্যে প্রটোকলসহ চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে চূড়ান্ত বাস্তবায়নে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দ্বিপক্ষীয় (ত্রিপক্ষীয়/চতুর্পক্ষীয়) চুক্তি/প্রটোকলের প্রস্তুতি, সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব চুক্তি/প্রটোকল নিয়ে আলোচনা ও অনুমোদন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে অনুমোদিত চুক্তিগুলোর জন্য পূর্বশর্ত (তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা, অবকাঠামো, ট্র্যাকিং, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) স্থাপন করা হবে।
যেসব রুটে গাড়ি চলবে: সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যেসব গাড়ি চলাচল করবে, সেগুলো শুধু স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ ও বাহির হবে। দেশের ২০টি স্থলবন্দরের ১৯টিই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে জড়িত। এসব বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াত করতে পারবে। একটি স্থলবন্দর টেকনাফ-মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে যাওয়া-আসার জন্য প্রাথমিকভাবে দুটি করে চারটি পথ চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেপালে যেতে ঢাকা-বাংলাবান্ধা-জলপাইগুড়ি-কাকরভিটা এবং ঢাকা-বুড়িমারী-চেংরাবান্দা দুটি পথ ব্যবহার করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আর ভুটানের পথ দুটি হচ্ছে ঢাকা-বুড়িমারী-চেংরাবান্দা এবং অন্যটি ঢাকা-সিলেট-শিলং-গুয়াহাটি। সম্প্রতি ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি পথে যে বাস চালু করা হয়েছে, সেটি দিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকজন ভুটানি ভ্রমণ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের পর্যটকরা নিজস্ব গাড়ি বা বাসে চড়ে এই চার দেশে বেড়াতে যেতে পারবেন। এজন্য রুট পারমিট নেয়ার দরকার হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য স্বল্পমেয়াদি এবং নিয়মিত যাতায়াতকারী বাস ও পণ্যবাহী গাড়ির জন্য দীর্ঘমেয়াদি রুট পারমিট দেয়া হবে। তবে ভিসা বা রুট পারমিট কোন প্রক্রিয়ায় পাওয়া যাবে তা সে বিষয়ে আগামীতে আলোচনা হবে বলে জানান তারা।
অগ্রাধিকারে ৩০ প্রকল্প: চার দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ উন্নীতকরণ এবং পরিবহন কানেকটিভিটি জোরদারে ৩০টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। এ অর্থ বাণিজ্য ও পরিবহন করিডরের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় হবে।