আজ ঢাকা আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

নতুন বার্তা নিয়ে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর : অন্তত ২০টি চুক্তির সম্ভাবনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: শুভেচ্ছা আর বন্ধুত্বের নতুন বার্তা নিয়ে দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ শনিবার ঢাকা আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এ সফরে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আর বন্ধন ভিন্ন মাত্রা পাবে ও নতুন উচ্চতায় পৌঁছুবে বলে আশা করা হচ্ছে। ৩৪ ঘণ্টার সফরে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে অন্তত ২০টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল স্বাক্ষর ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা সহজ ও দুদেশের মধ্যে সংযোগ বাড়ানোর ঘোষণা দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে নরেন্দ্র মোদী আজ সকাল সোয়া দশটায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানযোগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছুবেন এবং আগামীকাল রোববার রাত ৮টা ২০ মিনিটে ঢাকা ত্যাগ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান বন্দরে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত ও বিদায় জানাবেন।

এক বছর আগে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন নরেন্দ্র মোদী। এক বছর ধরে নানা আয়োজন, প্রস্তুতি ও আলোচনার পর বাংলাদেশে বহুল প্রতীক্ষিত সফর করছেন নরেন্দ্র মোদী। এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কয়েকটি প্রতিবেশীসহ ১৮টি দেশ সফর করলেও বাংলাদেশে আসতে তাত্পর্য ও গুরুত্ব বিবেচনায় এক বছর অপেক্ষা করেন তিনি। এরই মধ্যে ৪১ বছর আগে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি এপ্রিলে পার্লামেন্টে পাস করান প্রধানমন্ত্রী মোদী। সীমান্ত বিল পাসের পরই মোদীর সফর নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক তোড়জোড়। এক মাসের মধ্যেই ঢাকা আসার দিনক্ষণ ঠিক হয়। নরেন্দ্র মোদী সিদ্ধান্ত  নেন অতীতের ঝুলে থাকা সব ইস্যুর সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করে ঢাকার সাথে সম্পর্ক আরো সুদূর ও উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবেন। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক , সীমান্ত, জ্বালানি, নিরাপত্তা, পানি সম্পদ সবক্ষেত্রেই সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশও সব সময় বৃহত্ প্রতিবেশী ভারতের সাথে উষ্ণ ও গভীর সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নয়াদিল্লির সাথে সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। ২০১০ সালে তিনি ভারত সফর করেন এবং ২০১১ সালে তখনকার  প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা  আসেন।

তিস্তা নয় তবে ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক

ভারতের সাথে ঝুলে থাকা বহুল আলোচিত অভিন্ন তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নরেন্দ্র মোদীর এ সফরে আলোচ্যসূচিতে নেই। আগেই জানানো হয়েছে এবার তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। তবে তিস্তা নিয়ে দুপক্ষ আলোচনা করবেন ও অগ্রগতির কথা জানাবেন। দু প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর তাদের উপস্থিতিতে স্থল সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল বিনিময় হবে। তাদের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি চুক্তি/প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল, উপকূলীয় নৌ-চলাচল চুক্তি, পণ্যের মান স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় সহযোগিতা চুক্তি।

এছাড়াও উভয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, মানব পাচার প্রতিরোধ, জালনোট পাচার প্রতিরোধ, সমুদ্রভিত্তিক ব্লু-ইকোনমির ক্ষেত্রে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও সহযোগিতা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চুক্তি/সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এ চুক্তিসমূহ স্বাক্ষরের ফলে আঞ্চলিক আন্তঃসংযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে।

৩৪ ঘণ্টার কর্মসূচি

দুদেশের কর্মকর্তাদের প্রণীত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকায় ৩৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন নরেন্দ্র মোদী। তার সাথে থাকবেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্র সচিব এস জয় শংকরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সকাল সোয়া দশটায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদীকে অভ্যর্থনা জানাবেন। বিমানবন্দরে ফুলের তোড়া উপহার, ১৯ বার তোপধ্বনি, গার্ড অব অনার গ্রহণ ও গার্ড পরিদর্শন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচিতি পর্বসহ ব্যাপক আয়োজন রয়েছে।

বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে নরেন্দ্র মোদী যাবেন সাভার। সেখানে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ শেষে তিনি যাবেন ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন ও দর্শনার্থী বই-এ স্বাক্ষর করবেন মোদী। দুপুরে তিনি সোনারগাঁও হোটেলে যাবেন। ঢাকায় অবস্থানকালে এই হোটেলেই তিনি থাকবেন। বিকেল চারটায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সাড়ে চারটায় মোদি যাবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। দু প্রধানমন্ত্রী প্রায় আধঘণ্টা একান্তে বৈঠক করবেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদি ১৯৭২ সালে কোলকাতায় বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণের সিডি, ভারতের সংসদে স্থলসীমান্ত চুক্তি পাস হওয়ার সময় বিতর্কের প্রতিলিপি হস্তান্তর করবেন শেখ হাসিনার কাছে।

শেখ হাসিনাও ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি উপহার দেবেন নরেন্দ্র মোদিকে। এরপর দু প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে বসবেন আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনায়। এরপর তারা যৌথভাবে কয়েকটি কার্যক্রম ও প্রকল্প উদ্বোধন চুক্তিস্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করবেন। সন্ধ্যায় সোনারগাঁও হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করবেন। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রয়েছে। অপর সফরসঙ্গী পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গত রাতে কোলকাতা থেকে ঢাকা আসেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী যৌথভাবে বেশ কয়েকটি কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। কোলকাতা-আগরতলা বাস সার্ভিস ও ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিসের সূচনা; খুলনা-মংলা রেলওয়ে লাইন এবং কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সংযোগ পুনর্বহাল, শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে রবীন্দ্রভবন, সারদা পুলিশ একাডেমিতে মৈত্রী ভবন, ফেনী নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের একটি পরীক্ষাগার এবং একটি বর্ডার হাট উদ্বোধন করা হবে।

ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশন: নরেন্দ্র মোদি আগামীকাল রোববার সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশন পরিদর্শন ও  হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করবেন। এরপর তিনি যাবেন বারিধারার ভারতীয় হাইকমিশনের নবনির্মিত চ্যান্সারি ভবনে। সেখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় যোগ দেবেন তিনি।

বঙ্গভবনে যত আয়োজন: নরেন্দ্র মোদি আগামীকাল রোববার বেলা সাড়ে বারটায় বঙ্গভবনে যাবেন ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গভবনের দরবার হলে এক অনুষ্ঠানে ভারতের বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী  অটল বিহারী বাজপেয়ীর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণ করবেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নরেন্দ্র মোদিকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন।

খালেদা-রওশনসহ নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ: বঙ্গভবন থেকে বেলা তিনটায় নরেন্দ্র মোদি যাবেন সোনারগাঁও হোটেলে। সেখানে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সাক্ষাৎ করবেন।

সুধী সমাবেশ: নরেন্দ্র মোদি আগামীকাল রোববার সন্ধ্যায় দেড় ঘণ্টার সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতীয় হাইকমিশন আয়োজিত সুধী সমাবেশে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার মধ্যদিয়েই ৩৪ ঘণ্টার ঢাকা কর্মসূচি শেষ করবেন নরেন্দ্র মোদি। রাত ৮টা ২০ মিনিটে বিশেষ বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করবেন তিনি।

ইন্দিরা থেকে মোদি: স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে দ্বিপাক্ষিক আয়োজনে বাংলাদেশে সফরকারী বন্ধুপ্রতীম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী ষষ্ঠতম। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে আসেন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই। এরপর ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী দেবে গৌড়া, ১৯৯৯ সালের জুনে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং সর্বশেষ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে আসেন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ।

মোদী-মমতায় বর্ণিল ঢাকা: শ্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি নামেই বিশ্বজুড়ে সমধিক পরিচিতি তার। তিনি প্রথমবারের মতো পা রাখছেন ঢাকায়। ইতোমধ্যে ঢাকায় পৌঁছেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, একজন সারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আরেকজন বাংলাদেশ ঘেঁষা ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তারা দুজনেই এখন ঢাকায়। এসেছেন সরকারি সফরে। আর এ সফর স্মরণীয় করে রাখতেই ঢাকাকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। দেশের এ দু অকৃত্রিম বন্ধুকে বরণ করে নিতে হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে শুরু করে সোনারগাঁও হোটেল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন ‘গণভবন’, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশন, বারিধারা ভারতীয় চ্যান্সেরী নতুন ভবন ইত্যাদি জায়গা ঘিরে সড়কের মাঝ বরাবর, কোথাও  কোথাও সড়কের দুই পাশ বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে দুই দেশের জাতীয় পতাকা, নানা ছন্দে লেখা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন। এই সাজ-সজ্জায় বাড়তি মাত্রা দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টানানো তিন নেতার আলোকচিত্র। রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর নানা ভঙ্গিমার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাসিমাখা ছবিও টানানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। যা সহজেই যাত্রী-পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।