মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় পাচ্ছে সাগরের সাত হাজার মানুষ

আচেহ প্রদেশে ৪২৬ অবৈধ অভিবাসী উদ্ধার ; থাইল্যান্ড থেকে ৬০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে ; ১৫ দেশের সম্মেলনে থাকছে মিয়ানমারও

 

স্টাফ রিপোর্টার: মানব পাচারকারীদের কবলে পড়ে সাগরে ভাসমান মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও কিছু বাংলাদেশিকে এক বছরের জন্য আশ্রয় দেবে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। গতকাল বুধবার কুয়ালালামপুরে তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের এক যৌথ বিবৃতিতে অবৈধ অভিবাসীদের আশ্রয়ের বিষয়ে এ ঘোষণা দেয়া হয়। থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এই বৈঠকে অংশ নেন। তিনটি দেশের প্রতি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের আহবানের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত আসলো। সাগরে ভেসে বেড়ানো প্রায় ৭ হাজার অবৈধ এ মানবিক সহায়তা পাবে। গতকালই ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূল থেকে ৪২৬ জন অভিবাসন-প্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা কয়েক মাস ধরে সমুদ্রে ভাসছিলেন। আর অভিবাসী ইস্যুতে আগামী ২৯ মে ব্যাংককে ১৫টি দেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সম্মেলনে যোগদানের বিষয়ে সম্মত হয়েছে মিয়ানমারও।

এদিকে অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে থাকা ৬০ জন বাংলাদেশিকে শিগগিরই দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বর্তমানে তারা দেশটির রাজধানী ব্যাংককে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে ১৩ জনকে আগামী ২৭ মে এবং ১৭ জনকে ১ জুন দেশে ফেরত পাঠানো হবে। থাই সরকারের সহযোগিতায় বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনিম ইত্তেফাককে জানান, গত একবছরে ১২১৮ জন বাংলাদেশিকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৯৯ জনকে দেশে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের মধ্য থেকে ৬০ জনকে শিগগিরই দেশে পাঠানো হচ্ছে। এখনো যারা আছেন তাদেরকে থাই সরকার যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। অচিরেই তাদেরকেও দেশে পাঠানো হবে।

মানবপাচার নিয়ে সাম্প্রতিক সঙ্কট উত্তরণের পথ খুঁজতে কুয়ালালামপুরে ত্রিদেশীয় বৈঠক শুরুর আগেই গতকাল সকালে ইন্দোনেশিয়া উপকূলে ৪২৬ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়, যারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খাবার ও পানি ছাড়া নৌকায় আটকেছিলেন। গত দু সপ্তাহে দু হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারকারীদের নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাটিতে নামতে পারলেও এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ আন্দামান সাগর ও থাই উপকূলে আটকা পড়ে আছে বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ধারণা করছে।

গত কয়েকদিনে ওই তিন দেশের উপকূলরক্ষীরা মানুষবোঝাই বেশ কিছু নৌকা উপকূলে ভিড়তে না দিয়ে গভীর সাগরে ঠেলে দেয়, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউএনএইচসিআর, ওএইচসিএইচআর, আইওএম-এর প্রতিনিধি গত মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে সাগরে বিপদগ্রস্ত এ মানুষদের প্রাণ বাঁচানো এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর গতকাল কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাগরে ভেসে বেড়ানো প্রায় ৭ হাজার অবৈধ বিদেশগামীকে মানবিক সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য আশ্রয় শিবিরে জায়গা দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিজেদের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তিন দেশ সম্মত হয়েছে। বিবৃতিতে বিদেশগামীদের মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ওই বিদেশগামীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফা আমান ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার রিন্টো মার্সুদি এবং থাইল্যান্ডের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানাসাক প্রতিমাপ্রগর্ন ত্রিদেশীয় বৈঠকে অংশ নেন।

সঙ্কট সহায়তার আশ্বাস মিয়ানমারের: মিয়ানমারও আন্তর্জাতিক চাপে অভিবাসী সংকটে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। গত সোমবার মিয়ানমারের অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল এনএলডির এক মুখপাত্র ‘দেশহীন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে’ নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়ার জন্য দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে গতকাল জানিয়েছে, আঞ্চলিক অভিবাসী সঙ্কটে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উদ্বেগের সাথে একমত ইয়াংগুন। সমুদ্রে যারাই দুর্ভোগ পোয়াচ্ছে, তাদের মানবিক সহায়তা দিতে মিয়ানমার প্রস্তুত। যদিও মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে আসছে দেশটির সরকার।

দেশে ফিরছেন যেসব বাংলাদেশি: ৬০ জন বাংলাদেশির মধ্যে ২৭ মে সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ বিমানের ০৮৯ ফ্লাইটে ১৩ জন ফিরবেন। কক্সবাজার সদরের নুরুল আলম, মহেশখালীর জাহাঙ্গীর হোসেন, ফজল করীম, রামুর আবু সাঈদ, টেকনাফের সাব্বির আহমেদ, নুরুল আমীন, শফিক, মো. নুরু, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মো. ইয়াকুব, মাগুরা সদরের মোহাম্মদ সানারউদ্দিন, নরসিংদীর শিবপুরের মো. খোকন, বগুড়া সদরের নুর হাসান ও শিবগঞ্জের আতিকুর রহমান। আগামী ১ জুন বাংলাদেশ বিমানে দেশে ফিরবেন আরো ১৭ জন। এরা হলেন: নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জসিমউদ্দিন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের রুবেল, মো. রায়হান, সুনামগঞ্জ দুয়ারারবাজারের মো. জোবেল মিয়া, পাবনার সুজানগরের মো. শিপন, যশোরের চৌগাছার মুক্তার, মোশাররফ, টিটু রহমান, আবু মোছা, মুসলিম, উজ্জল হোসেন, সাতক্ষীরার তালার বাবু, ধানদিয়া ইউনিয়নের মো. সবুজ, কুষ্টিয়ার মিরপুরের লালমিয়া, নরসিংদীর রায়পুরার মুক্তার হোসেন, শিবপুরের শাহিন ও হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের আলমগীর।

ব্যাংককস্থ বাংলাদেশি দূতাবাসের কনস্যুলার মোহাম্মদ এহতেশামুল হক বলেন, বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে যারা আছেন তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। দেশে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে থাই সরকারও। এমনকি যারা আর্থিকভাবে দুরবস্থায় আছে তাদেরকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম আর্থিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। দূতাবাস থেকে পাঠানো বাংলাদেশি শনাক্তকরণ কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা গেলে বাকিদের সহসাই দেশে পাঠানো সম্ভব বলে জানান তিনি।