স্টাফ রিপোর্টার: মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে এক ব্যতিক্রমী রবির কিরণে উজ্জ্বল একটি দিন পঁচিশে বৈশাখ। ১৮৬১ সালের এদিনে কোলকাতার জোড়াসাঁকোয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির কবি – বাংলার কবি, বিশ্ব কবি, কবিগুরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা ২২ শ্রাবণ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি হয়ে বাঙালির হূদয়ে চির আসন করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাণী দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ও দার্শনিক চেতনা ছিল- শুধু নিজের শান্তি বা নিজের আত্মার মুক্তির জন্য ধর্ম নয়। মানুষের কল্যাণের জন্য যে সাধনা তাই ছিলো তার ধর্ম। তার দর্শন ছিলো মানুষের মুক্তির দর্শন। মানবতাবাদী এই কবি বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কবিতায়, গানে, গল্পে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সেই দর্শনের অন্বেষণ করেছেন তিনি। তার কবিতা, গান, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার লেখনী মানুষকে আজো সেই অন্বেষণের পথে, তার অন্বিষ্ট উপলব্ধির পথে আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মন-মানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন।
তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতও তাঁরই রচনা। তিনিই একমাত্র কবি যিনি দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে নোবেল বিজয়ী এই বাঙালি কবিকে স্মরণ করবে তার অগণিত ভক্তরা। শুধু দুই বাংলার বাঙালিই নয়, পুরো ভারতবাসী এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষাভাষী ও অন্য ভাষার ভক্তরা কবির জন্মবার্ষিকী পালন করবে হূদয় উত্সারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়। এবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’।
জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদ্যাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজাদপুরের পাইলট হাইস্কুল মাঠে আজ সকাল ১০টায় জাতীয় পর্যায়ে জন্মবার্ষিকী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ হাসিবুর রহমান স্বপন উপস্থিত থাকবেন। স্বাগত বক্তৃতা দেবেন ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। রবীন্দ্র স্মারক বক্তা হিসেবে এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উপস্থিত থাকবেন।
ঢাকাসহ কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর ও খুলনার দক্ষিণডিহিতে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করবে। কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ৯ মে শনিবার বাংলা একাডেমিতে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদ্যাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলসমূহ ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করবে।
জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাতীয় পর্যায়ে মূল অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রদান করবে। রবীন্দ্রনাথ ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস জোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাসমূহ প্রাণের সঞ্চার করে। আমাদের প্রতিটি সংগ্রামেই শুধু নয়, কবির চিরায়ত রচনাসমগ্র আজীবন স্মরণের শীর্ষতায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কবির বিভিন্ন রচনা স্বাধীনতা অর্জনে বিপুল প্রেরণা জুুগিয়েছিল। এ জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র, কথাসািহত্য, কৃষি, সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের জাগরণে কবি রবীন্দ্রনাথ পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিনদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকায় যেসব অনুষ্ঠান রয়েছে-
ছায়ানট: সন্ধ্যা ছয়টায় ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে শুরু হবে দুই দিনের রবীন্দ্র-উত্সব। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন অধ্যাপক সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্সবে ছায়ানটের পাশাপাশি সুরতীর্থ, সুরের ধারা, জাগো আর্ট সেন্টার, ভাবনাসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেবে। থাকছে একক গান ও পাঠ। রবীন্দ্রনাট্যে ব্যবহূত গান পরিবেশন করবে সুরের ধারা। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র-চিত্রকলা’ বিষয়ক বক্তব্য রাখবেন উদ্বোধক সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় দিন কাল শনিবার একই সময় থাকছে কবিতা থেকে গান নিয়ে সন্জীদা খাতুনের গ্রন্থনা ‘রূপে রূপে অপরূপ’।
এবি ব্যাংক-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা: তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই ভবনে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী এবি ব্যাংক-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা এ মেলা সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই। মেলায় থাকছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০টি স্টল। এসব স্টলে প্রদর্শন করা হবে রবীন্দ্র গ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লেখা গ্রন্থ, রবীন্দ্র চিত্রকলা ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড কভারের প্রদর্শনী। থাকবে রবীন্দ্র পোশাক, রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত ভিডিও সিডি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের স্টল, রবীন্দ্র চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ঠাকুরবাড়ির রূপসজ্জা ইত্যাদি। নাট্যজন আতাউর রহমানকে ভূষিত করা হবে রবীন্দ্রমেলা সম্মাননায়।
জাতীয় জাদুঘর: সন্ধ্যা ৭টায় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসরের আয়োজন করেছে জাতীয় জাদুঘর। প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা: সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে সন্ধ্যা ছয়টায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়েটার হলে স্বপ্নদল মঞ্চস্থ করবে ‘চিত্রাঙ্গদা’।