ভারতের রাজ্যসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল পাস

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন ইতিহাস রচিত হলো

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভারতের রাজ্যসভায় সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে সংবিধান সংশোধনী বিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিলটি উত্থাপন করেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ায় কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই বুধবার রাজ্যসভায় বিলটি পাস হয়। বিলের পক্ষে ১৮১ সদস্য ভোট দেন। বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথে একটি বড় বাধা অতিক্রম হল। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি রাতেই বিলে সই করেন। আজ বৃহস্পতিবার বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। লোকসভাতেও বিলটি সহজেই পাস হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি হবে ভারতের সংবিধানের ১১৯তম সংশোধনী। গতকাল বুধবার বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপনের পর আলোচনা শুরু হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিল পাসের জন্য রাজ্যসভায় উত্থাপন করেন। এর ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা খোশমেজাজে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেন। কেউ কেউ শেখ হাসিনার সরকারকে ভারতের বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেন। কেউ আবার সীমান্ত চুক্তির পথ ধরে বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। তারপর বিপুল করতালিতে বিলটি পাস হয়ে যায়। এর আগে মঙ্গলবার ভারতের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিলটি অনুমোদন দেয়া হয়। এদিকে রাজ্যসভায় স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়ায় স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলগুলোতেও বইছে আনন্দের বন্যা। আজ বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা হবে। ভারতের লোকসভার চলতি বাজেট অধিবেশন শেষ হচ্ছে ৮ মে। এর আগেই বিলটি পাস হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফরের আগেই এই বিল পাস হচ্ছে। মোদি অবশ্য আগেই বলেছেন, খালি হাতে বাংলাদেশে আসবেন না।

সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অচিহ্নিত স্থলসীমান্ত চিহ্নিত করা, ছিটমহল বিনিময় এবং অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর হবে। ফলে দীর্ঘ দিনের ঝুলে থাকা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সীমান্তে সংঘাত কিংবা অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তির বিল পাস হওয়ার পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পার্লামেন্টকে অভিনন্দন জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। বুধবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিনন্দন জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বাধা কেটে গেছে। আশা করছি, বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে। এর মাধ্যমে দুদেশের ছিটমহলে যেসব নাগরিক আছেন, তারা তাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাবেন। এ সময় পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন।

সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ভারতের পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে বিলটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করাতে হবে। এরপর চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যের বিধানসভায় কমপক্ষে অর্ধেক ভোটে অনুসমর্থন করতে হবে। তারপর ছিটমহলের নাগরিকদের নাগরিকত্ব পছন্দ করতে বলা হবে। নাগরিকদের পছন্দমতো তাদের আÍীকরণ করা হবে। এছাড়াও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে ছিটমহলগুলোর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য। তিনি আরও বলেন, সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনে বাংলাদেশেও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা ভারতের কাছে বেরুবারি হস্তান্তরের জন্য বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন ছিল। তবে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বুধবার রাতে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে এমন সম্ভাবনা নাকচ করে বলেন, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ২০১১ সালের এ সংক্রান্ত প্রটোকল বাংলাদেশ মন্ত্রিসভায় অনুসমর্থন করেছে। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে অনুসমর্থন প্রয়োজন নেই।

বিল পাসের বিষয়টি ভারতের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগেই সোমবার রাতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর বাসভবনে বিজেপি ও আরএসএসের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকে চূড়ান্ত হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু, স্বরাষ্ট্রৎমন্ত্রী রাজনাথ সিং, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী ও আসামের বিজেপি সংসদ সদস্য সর্বানন্দ সনোয়ালসহ রাজ্যের সব সংসদ সদস্য এতে উপস্থিত ছিলেন। আসামের বিজেপি সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যকেও জরুরি তলব করা হয়। সেখানেই আসামকে অর্ন্তভুক্ত রাখার সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়।

রাজ্যসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ায় খুবই স্বস্তি প্রকাশ করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিল পাসের পর সাথে আলাপকালে এক সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রাজ্যসভায় এই বিল পাস হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং সন্তোষ্ট। এবার মনে হচ্ছে, সীমান্ত চুক্তি চূড়ান্তভাবেই বাস্তবায়িত হবে। আমি আশা করি, আগামী মাসে যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন তবে সেটা হবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বড় মাইলফলক।

তিনি আরও বলেন যে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতটা উন্নতি হবে অন্য কারও ক্ষেত্রে তা হবে না। কেননা অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে তা বুঝবে না। ফলে ভারতীয়দেরও কোনো ভাবেই শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলা উচিত হবে না। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি যুগান্তরকে বলেন, এটি একটি ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি যে, সম্পূর্ণভাবে এই বিল পাস হচ্ছে। এখন এটি লোকসভায় পাস হচ্ছে। সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা একটি সমস্যার সমাধান হবে।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সীমান্ত চুক্তি বিলে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তিতে সমর্থন দিয়েছে। এটা জনগণ চায়। তবে সীমান্ত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

সীমান্ত চুক্তিতে যা আছে: বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তিতে তিনটি উপাদান রয়েছে। এক. সীমান্তে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত চিহ্নিত করা। সীমান্তের তিনটি স্থানে এই সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত রয়েছে। এই স্থানগুলো হল- বাংলাদেশের নীলফামারী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশের ফেনী জেলার মুহুরি নদী ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া এবং বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার লাঠিটিলা এবং ভারতের আসাম রাজ্যের দুমাবাড়ি।

অচিহ্নিত স্থলসীমান্ত চিহ্নিত করা ছাড়াও এই চুক্তির প্যাকেজে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় এবং পাঁচ হাজার একর এলাকাজুড়ে অপদখলীয় ভূমি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভারত ১৭ হাজার ১৫৮ একর ভূমি সংবলিত ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। এসব ছিটমহলে জনসংখ্যা রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন। ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের চারটি জেলায় অবস্থিত। কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, নীলফামারী জেলায় চারটি এবং পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি ছিটমহল।

ভারতে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের সবগুলোই কোচবিহার জেলায় অবস্থিত। ভারতে বাংলাদেশী ছিটমহলের মোট ভূমির পরিমাণ সাত হাজার একশ দশ একর এবং এসব ছিটমহলে মোট জনসংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫ জন। ছিটমহল বিনিময় সম্পাদিত হলে বাংলাদেশ ১০ হাজার একর ভূমি বেশি পাবে। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ওই সব ভূখণ্ডের অধিবাসীদের ছয় দশকের বেশি সময়ের মৌলিক মানবিক সংকটের অবসান হবে। অপদখলীয় ভূমির ক্ষেত্রে ভারত দুই হাজার সাতশ ৭৭ দশমিক শূন্য ৩৮ একর ভূমি পাবে। বাংলাদেশ পাবে দুই হাজার দুইশ ৬৭ দশমিক ৬৮২ একর ভূমি।