পাচারকারীদের আরও ৬০ ক্যাম্পে হত্যা ৫শ

থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের গভীর জঙ্গলে রোমহর্ষক নৃশংসতা

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের গভীর জঙ্গলে আরও অন্তত ৬০টি মানব পাচারকারী ক্যাম্প পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন অব থাইল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট এমন দাবি করেছেন। ক্যাম্প থেকে জীবিত ফিরে আসা একজন দাবি করেছেন, ক্যাম্পে অন্তত ৫শ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা মুসলিম।

আবদুল কালাম নামে রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশনের ওই সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, সঙ্গাকোলা সেডাও জেলায় এসব ক্যাম্পের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব ক্যাম্পের অধিকাংশই মালয়েশিয়ার সাইডে অবস্থিত। তিনি বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে ১৫০-৮০০ শরণার্থী রয়েছে।

থাই জঙ্গল থেকে সম্প্রতি যে ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করে পরে দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কাজিম। তার এক আত্মীয় কুরামিয়া তাকে উদ্ধারের জন্য ৯৫ হাজার বাথ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা ওই অভিবাসী দাবি করেছেন, কাজিমকে পিটিয়ে হত্যা করেছে অরুণা নামে এক পাচারকারী। তিনি নিজের চোখে সেটা দেখেছেন। তিনিই থাই গণমাধ্যমকে থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তের বিভিন্ন ক্যাম্পে এরকমভাবে অন্তত পাঁচশ মানুষকে হত্যা করার কথা জানিয়েছেন। তবে তার নাম প্রকাশ করেনি থাই গণমাধ্যম।

তিনি মাস ছয়েক আগে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভনে পড়ে যাত্রা করেছিলেন। কাজিম আর তিনি একই ক্যাম্পে থাকতেন। পাশাপাশি এ রকম আরও বেশ কিছু ক্যাম্পে অন্তত ৭শ থেকে ৮শ অভিবাসী থাকত বলে জানিয়েছেন তিনি। তাকে উদ্ধার করতে তার মাকে শেষ আশ্রয়ও বিক্রি করতে হয়েছে।

কাজিমকে উদ্ধারেও মুক্তিপণের টাকা দিয়েছিলেন তার আত্মীয় কুরামিয়া। পাচারকারী অরুণাকে তিনি কাজিমের মুক্তিপণ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা নিয়েই কেটে পড়ে অরুণা। ১২ দিন পর আরও অর্থ দাবি করে সে। বিষয়টি পুলিশকে জানায় কুরামিয়া। পুলিশের কাছে অভিযোগ দেয়ায় কাজিমকে পিটিয়ে হত্যা করে পাচারকারীরা। হত্যার সময় কাজিমের এক আত্মীয়কে ফোন করে ফোনটি কাজিমের মুখের সামনে ধরে তারা। কাজিমের সে আত্মীয় রয়টার্সকে বলেছেন, ফোনে কাজিম বলছিলো, তারা আমাকে মেরে ফেলছে। আপনারা কি করলেন আমার জন্য? কাজিমের আত্মীয়ের এ অভিযোগের ব্যাপারে থাই পুলিশ বলছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।

পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আটক: থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গল থেকে মানবপাচারকারীদের মূল হোতাকে গ্রেফতারের দাবি করেছে থাইল্যান্ডের পুলিশ। পুলিশ বলছে, তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। গ্রেফতার ব্যক্তির নাম সু নাইং, তবে তিনি আনোয়ার নামেই বেশি পরিচিত।

নাখোন সি থামারাট প্রদেশের পুলিশের ডেপুটি কমিশনার অনুচন চামসাট গণমাধ্যমে বলেছেন, জঙ্গলের গভীরে বেশ কিছু পাচারকারী ক্যাম্প পুলিশ উচ্ছেদ করেছে। যেগুলোতে প্রায় ৪শ অভিবাসীকে মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখা হয়েছিলো। মুক্তিপণ পাওয়ার পরও মুক্তি না দেয়ার অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মানবপাচারের শিকার অবৈধ অভিবাসীদের জীবনের ভয়াবহ বাস্তবতার কথা। পুলিশের এ কর্মকর্তার দাবি, সম্প্রতি যে ২৬ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে সে ব্যাপারে আনোয়ারের কাছ থেকে বিস্তারিত জানা যাবে। আনোয়ারকে শীর্ষ পাচারকারী বলেও দাবি করেন তিনি। এছাড়া থাই পুলিশ বলছে, ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যাংক রিসিটে অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত এক মাসেই এ চক্রটি প্রায় ১০ মিলিয়ন বাথ (থাই মুদ্রা) অর্থ আদায় করেছে।

তবে আনোয়ারের দাবি, মানব পাচারের সাথে সে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তাকে কেউ ফাঁসাচ্ছে। তিনি জানান, পাউরুটি বিক্রি করে কোনোরকমে সে জীবন চালায়। পুলিশ এক আনোয়ারকে খুঁজতে গিয়ে আরেক আনোয়ারকে ধরে এনেছে। অনেকের নামই আনোয়ার। আমার নামও। কিন্তু সত্যিই কোনো আনোয়ার অপরাধী সেটা তো বের করতে হবে।

জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মানবপাচারের অভিযোগে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। ফোন রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড থেকেই এ মানবপাচার চক্রটি নিয়ন্ত্রিত হয়। আনচন বলেন, খুন, মানব পাচার, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম আনোয়ারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছে পুলিশ। জঙ্গলে পাওয়া গণকবরের আশপাশ থেকে ডিএনএও সংগ্রহ করা হয়েছে, যাতে সেখানে আনোয়ারের উপস্থিতির বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় গেছে: একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানের বরাতে বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রথমে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ড এবং পরে মালয়েশিয়ায় গেছে। এ যাত্রায় তারা সমুদ্রপথ ব্যাবহার করে এবং অনেক সময় মাসের পর মাস বিভিন্ন জঙ্গলে ক্যাম্প করে থাকে।

মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এমি স্মিথ বলেন, শুক্রবার জঙ্গলে যে ক্যাম্পটির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটি এ অঞ্চলে বহু ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র একটি। এ রকম আরও বহু ক্যাম্প দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জঙ্গলে এ ধরনের কোনো ক্যাম্পের সন্ধান এটাই প্রথম। থাই কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে এসব ক্যাম্প উচ্ছেদ করা।

শুক্রবার মালয়েশিয়া সীমান্ত থেকে কয়েকশ মিটার ভেতরের এই ক্যাম্পটিতে পুলিশের সাথে গিয়েছিলেন এক সাংবাদিক। তিনি দেখেছেন, ক্যাম্পটিতে প্রচুর পরিমাণে বাঁশের লাঠি এবং পাইপ আছে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে এগুলো ফেলে রেখেই পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। এসব দেখে ধারণা করা যায়, পাচারকারীরা অভিবাসীদের এসব লাঠি দিয়ে নিয়মিত মারধর করতো। ক্যাম্পে যেসব মরদেহ পাওয়া গেছে তাদের শরীরেও লাঠি দিয়ে পেটানোর চিহ্ন দেখেছেন এ রিপোর্টার। এছাড়া উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া আরও দুজন পুলিশ সদস্য ও রয়টার্সকে একই ধরনের কথা বলেছেন।

সাবেক এক মানবপাচারকারী, যে পুলিশকে ক্যাম্পটি চেনাতে সাহায্য করেছে, তিনি বলেছেন, ফোনে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়ার জন্য অভিবাসীদের নিয়মিত মারধর করা হয়। আর যারা পালিয়ে যেতে চায়, তাদের হত্যা করা হয়।

এ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা একজন (তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তিনি এখন পুলিশ হেফাজতে আছেন) বলেছেন, গত ১০ মাসে ক্যাম্পে থাকাকালীন অন্তত ১৭ জনকে হত্যা করতে দেখেছেন তিনি। এমনকি মাত্র দু ঘণ্টার ব্যবধানে চারজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, মরদেহে নির্যাতনের চিহ্ন তারা পায়নি।