একপক্ষের অবাধ কেন্দ্র দখল ব্যালট পেপার ছিনতাই অপরপক্ষের বর্জনে সিটি নির্বাচন

ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক দক্ষিণে সাঈদ খোকন চট্টগ্রামে আ..ম নাছির মেয়র নির্বাচিত

 

স্টাফ রিপোর্টার: কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, জালভোটের মহোৎসব এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়, চলে টানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় ভোট গণনা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন নিশ্চিত বিজয়ের পথে রয়েছেন।

তিন সিটি করপোরেশনের এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহের পাশাপাশি ছিলো শঙ্কা। গতকাল সকালে ভোট শুরুর পর বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে। কিছু কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়। মাঝপথে দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। বিএনপি ছাড়াও আরো কয়েকজন মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচন বর্জনের কথা জানান।

নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, ব্যালট বাক্স দখল, অবাধে জাল ভোট এবং ভোটারদের বাধা দেয়ার অভিযোগ এনেছে বিএনপি। তারা বলেছে, শুরু না হতেই শেষ। তাতেই জয়-পরাজয় নিশ্চিত। কিন্তু কীভাবে? ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনে মাত্র চার ঘণ্টায় কীভাবে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয়। ডিসিসি নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের মারধর, ভয়ভীতি ও অস্ত্র প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল, জালভোট আর প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ওপর হামলার মধ্যদিয়েই এ নির্বাচনের ফল কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে। ফলে ভোট শুরুর চার ঘণ্টার মধ্যেই এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।

গতকাল দুপুরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আবারো প্রমাণিত হলো, এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নেই। সুষ্ঠু তো দূরের কথা, নির্বাচন একেবারে অর্থহীন করে দেয়া হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তার অভিযোগ, ৮০ শতাংশ কেন্দ্রে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। একই সংবাদ সম্মেলনে সেখানকার বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।

ভোট শুরুর পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন এবং স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নির্বাচনের নানা রকম অনিয়ম ও সহিংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু সরকার সমর্থকরাই নন, অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তারাও এসব অনিয়মে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছেন। এসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় সংবাদকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা এবং সরকারি দলের নেতারা বার বার দাবি করেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, তিন সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ৬০ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ভোটার প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ, ঢাকা দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার এবং চট্টগ্রামে ১৮ লাখ ১৩ হাজার। এ নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে বেশি আলোচিত হন ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক ও বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল, ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মির্জা আব্বাস ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত মোহাম্মদ মনজুর আলম ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আ.জ.ম নাছির উদ্দিন।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গতকালের নির্বাচনে তিন সিটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৭৮ হাজার ৭৩০ জন সদস্যের দায়িত্ব পালনের কথা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ৩০ হাজার ৭৬৪, ঢাকা দক্ষিণে ২৬ হাজার ৪৯৬ এবং চট্টগ্রামে ২১ হাজার ৪৭০ জন। বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যেও সার্বিকভাবে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কমিশনে তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি কিছু পাওয়া যায়, তা কমিশন বিবেচনা করবে। তবে এ নির্বাচনে কতো শতাংশ ভোট পড়েছে, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি নির্বাচন কমিশন। সিরাজুল ইসলাম জানান, গোলযোগের কারণে ঢাকা দক্ষিণে বংশালের সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, জুরাইন আশরাফ মাস্টার আদর্শ বিদ্যালয় এবং খিলগাঁওয়ের একটি মিলিয়ে মোট তিনটি ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে ইসি। সিটি করপোরেশনের এ নির্বাচন আইন অনুযায়ী দলীয় ভিত্তিতে না হলেও প্রার্থী ঠিক করাসহ সবকিছু কার্যত রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে। সকালে ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্র ভোটের জন্য খুলে দেয়ার পর সেখানে প্রথমেই ভোট দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভোটার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভোট দেয়ার পর বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, জিতলে ভালো, না জিতলে আন্দোলন। আর তাদের আন্দোলন মানে তো মানুষ খুন করা। এরপর প্রথম ঘণ্টা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই সব চলে। নির্বাচনী কর্মকর্তারাও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু সকাল ৯টার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ জানাতে থাকেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের ৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস এবং ঢাকা উত্তরের মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে পাশে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটা কোনো নির্বাচন হয়নি। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। ভোটবিহীন এ নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।…এ নির্বাচন আমরা বর্জন করছি। এতে গণতন্ত্রের প্রহসন করা হয়েছে। আফরোজা ও তাবিথ অভিযোগ করেন, তাদের এজেন্টদের হয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, নয় তো বের করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্র দখল করে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে।

নেতারা অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এলেও ঢাকা বা চট্টগ্রামে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ভোটের সময় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদেরও কেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। বংশালের সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষ্মীবাজারের কবি নজরুল কলেজ, হাজারীবাগের জরিনা শিকদার স্কুল এবং উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়সহ ঢাকার দু সিটি করপোরেশনের কয়েকটি কেন্দ্রে যেসব সংঘর্ষ হয়েছে, তার মূলে ছিলো কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। এসব সংঘর্ষের জেরেই তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। পুরান ঢাকার পোগোজ স্কুল কেন্দ্র, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, মোহাম্মদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র, ঢাকা কলেজ, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় এবং ধলপুর সিটি করপোরেশন স্টাফ কোয়ার্টার উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত হয় বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।

পুরান ঢাকার নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষ্মীবাজারের কবি নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের বিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়, অলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন বহুমুখি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদ কলেজ কেন্দ্র দখল করে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীদের ব্যালটে সিল মারতে দেখা যায়। তারপরও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ হয়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ভোট বর্জনের কথা বলে বিএনপি নেতৃত্ব নতুনভাবে আন্দোলনে নামার অপচেষ্টা করছে। তিনি বলেন, নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেখাতে পারেনি। কোনো একটি অনিয়মের তথ্য দিতে পারেনি বিএনপি। আর অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ শুধু বলেন, আপনারা দেখান, আপনারা দেখান।

নির্বাচনের আগের দিন সিইসি অভিযোগ করেছিলেন, কোনো ধরনের অনিয়ম বরদাশত করা হবে না। তবে ভোটের দুপুরে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান। নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হচ্ছে। ঢাকায় এ নির্বাচন হলো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার অন্তত ৮ বছর পর। সর্বশেষ অবিভক্ত ঢাকা সিটির নির্বাচন হয়েছিলো ২০০২ সালের এপ্রিলে। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করার পর এটাই প্রথম নির্বাচন।

চট্টগ্রামে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নির্ধারিত সময়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে এটি পঞ্চম নির্বাচন। এ সিটিতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিলো ২০১০ সালের ১৭ জুন। ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৬ জন ভোটারের এ তিন সিটি করপোরেশনে ২৭০১টি ভোটকেন্দ্রের ১৫ হাজার ৫৪৪টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হয়। তিন সিটিতে মেয়র পদে ৪৮, সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৯১ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ২৪৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন।