টাইগারদের দাপট : হোয়াইটওয়াশ পাকিস্তান

স্টাফ রিপোর্টার: মুশফিকের শট বাউন্ডারি দড়ি স্পর্শ করার আগেই মাতাল হয়ে উঠলো গ্যালারি, মেতে উঠলো যেন সারাদেশ। এবার আর নীরব রইলেন না ক্রিকেটাররাও। মুশফিক দু হাত শূন্যে তুলে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, তারা কী অর্জন করেছেন। হ্যাঁ, আরেকটি ইতিহাস ছুঁয়েছে বাংলাদেশ; নতুন এক ইতিহাসও লিখেছে বাংলাদেশ। এক, দুই, তিন। ১৬ বছর পর প্রথম জয়, পরের ম্যাচে জিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয় আর তৃতীয় ম্যাচে জিতে হোয়াইটওয়াশের গৌরব। সফরের একমাত্র টি-২০ খেলাটি অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল একই মাঠে।

৬৩ বল হাতে রেখে ৮ উইকেটের জয়। তৃতীয় ম্যাচের এ জয়ে টাইগাররা বুঝিয়ে দিলো ঠিক এ দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলো তারা। তাই তো প্রথম দু ম্যাচে জিতে উদ্যাপনের মোহে জড়িয়ে পড়েননি তারা।

মিরপুরে গতকাল জুনায়েদের বলে বাউন্ডারি মেরে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরই সৌম্য ও মুশফিকের পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সে কী আনন্দ! ফ্লাডলাইটের আলোয় অনাবিল উৎসবে শামিল তখন পুরো গ্যালারি। একেবারেই বলে-কয়ে পাকিস্তানকে তিন ম্যাচে হারানো। এ বাংলাদেশকেই ক’দিন আগেও ঠিক এভাবে হারাত যারা, তাদেরই সেই দুঃখভরা অভিজ্ঞতার স্বাদ ফিরিয়ে দিলেন মাশরাফিরা। বুঝিয়ে দিলেন সময় পাল্টেছে। ভালোভাবেই পাল্টেছে। বদলে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ম্যাচ জয়ের চেয়েও দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখল সৌম্য সরকারের ব্যাটিং সৌন্দর্য। কোন শট ছিল না ব্যাটিংয়ে সেটাই খুঁজে পাওয়া ভার। সৌম্যের সেঞ্চুরি (১২৭*) ও তামিম ইকবালের হাফ সেঞ্চুরিতে (৬৪) বাংলাদেশ জিতলো ৮ উইকেটে। ২৫১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ৩৯.৩ ওভারে দুই উইকেট হারিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।

কাল টস জিতে পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের শুরুটা অবশ্য হয়েছিলো দারুণ। তবে তা ম্লান হয়ে যায় তামিম-সৌম্যের ব্যাটিং ঔজ্জ্বল্যের কাছে। দুজনে মাতিয়ে রাখেন পুরো গ্যালারি। সৌম্যের শুরুটা হয়েছিলো স্বভাবসুলভ, কিন্তু তামিম একটু ধীরে চলার নীতিতে থেকেই লম্বা লম্বা শট খেললেন। দু বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের শটগুলো সাজালে একটা সুন্দর বৃত্তই হয়ে যায়। টানা তিন সেঞ্চুরির রূপকথার খুব কাছ থেকেই ফিরে এলেন তামিম। ৭৬ বলে আট চার ও এক ছয়ে ৬৪ করে আউট হন তামিম। জুনায়েদের বলে এলবিডব্লুর আউটটা যেন বিশ্বাসই হয়নি তার। কিন্তু রিভিউ নিয়ে সিদ্ধান্ত পক্ষে নিতে পারেননি এ ড্যাশিং ওপেনার। ২৫.৩ ওভারে ভেঙে যায় ১৪৫ রানের জুটি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে অনেকেরই নজর কাড়লেও বড় স্কোর করতে পারছিলেন না সৌম্য। অবশেষে তিনি দারুণ মেজাজে ছুঁয়ে ফেললেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। আজহারের পরপর দু বলে পরাস্তই হয়েছিলেন সৌম্য; কিন্তু তৃতীয় বলে ডিপ-মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে পৌঁছে যান সেঞ্চুরিতে। সেঞ্চুরি করেই হ্যালমেট খুলে হাত ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না এখন কী করবেন! তবে প্রথম শতক বলে কথা। উদ্যাপনের রেশ একটু দীর্ঘ না হয়ে পারেই না। দুর্দান্ত ইনিংসের পথে ৪৮ রানে একবার জীবন পেয়েছিলেন তিনি। হাফিজের বলে ওই সময়ে ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন রিজওয়ান। তামিম আউট হওয়ার পর মাহমুদউল্লাহ আরও একবার ব্যর্থ হলে মুশফিক-সৌম্য সময়ের আগেই জয়ের বন্দরে নিরাপদে পৌঁছে দেন দলকে।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মিসবাহ-উল-হক যা করতে পারেননি তৃতীয় ম্যাচে নেতৃত্ব দিতে নেমে সেটাই করে দেখালেন আজহার আলী। অধিনায়ক হওয়ার পর মিসবাহ একের পর এক হাফসেঞ্চুরি করলেও সেঞ্চুরির দেখা পাননি। অথচ বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৭২, দ্বিতীয় ম্যাচে ৩৬-র পর এবার সেঞ্চুরি পেয়ে গেলেন আজহার আলী। ১১২ বলে ১০ চারে ১০১। অধিনায়কের দারুণ সেঞ্চুরির পরও বাকিদের ব্যর্থতায় পাকিস্তানের বড় সংগ্রহের আশাটা শেষ হয়ে গেল ২৫০ রানেই।

টস ভাগ্য ভালোই বলতে হয় আজহারের। দ্বিতীয় ওয়ানডের মতো কালও টস জিতেও ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। বাংলাওয়াশ ঠেকানোর উদ্দেশে শেষ ম্যাচে তিনটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে পাকিস্তান। সাঈদ আজমল, রাহাত আলী ও সরফরাজের জায়গায় খেলেছেন সামি আসলাম, জুলফিকার বাবর ও অভিজ্ঞ উমর গুল। অভিষিক্ত সামি আসলাম কাল শুরুতেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। অধিনায়ক আজহার আলী তাকে নিয়ে পাকিস্তানের সেরা শুরুটাই করেন। ১৮ ওভারেই এই জুটি তুলে ফেলে ৯১ রান। অভিষেকেই হাফসেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখালেও নাসির তাকে ফেরান ৪৫-এ। প্রথম দুই ম্যাচের বোলিংয়ের সঙ্গে কাল শুরুর বোলিংয়ে কোনো মিলই ছিল না বাংলাদেশের। তাসকিন দুই ওভারে দেন ২২ রান। রুবেল প্রথম স্পেলে নয়ের উপরে রান দিয়েছেন। হোয়াইটওয়াশের স্বপ্নটা তখন দূরের বাতিঘর মনে হচ্ছিল। তবে আগের ম্যাচে বোলিংয়ে নিষ্প্রভ থাকা মাশরাফি প্রথম স্পেলে থামেন পাঁচ ওভারে ১৭ রান দিয়ে। সেরা ফর্ম দেখিয়েই তার প্রত্যবর্তন হল। সিরিজের আগে মোহাম্মদ হাফিজকে বাংলাদেশের জন্য আতংকের কারণ মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তিন ম্যাচে হাফিজের স্কোর-৪, ০ ও ৪। কাল তাকে ফেরান আরাফাত সানি। এই সময়ে সাময়িক কিছুটা চাপে পড়লেও তৃতীয় উইকেটে হারিস সোহেলের সঙ্গে আজহার ৯৮ রান তুলে ধাক্কা সামলান। পেসারদের ব্যর্থতার পর স্পিনাররাও তখন উইকেট নিতে পারছিলেন না। তবে অভিজ্ঞ সাকিব ও মাশরাফি সেরা দুই পারফরমারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান। সাকিব ফেরান সেঞ্চুরিয়ান আজহারকে, মাশরাফি ফেরান হাফসেঞ্চুরিয়ান হারিস সোহেলকে (৫২)। মাশরাফি ফাওয়াদের উইকেটটা পেলেও বাউন্ডারিতে অসাধারণ ক্যাচ ধরার জন্য কৃতিত্ব দিতে হয় নাসির হোসেনকেই।

২০৩/২ থেকে ২০৭/৪। এরপর তো পাকিস্তানের ওপর দিয়ে সুনামি বইয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ বোলাররা। শেষ ৪৭ রানে পাকিস্তান হারায় আট উইকেট। আগের ম্যাচে ডেথ ওভারে রুবেলকে বল দেননি মাশরাফি। কাল আর সেই ভুল করলেন না। পর পর দু ওভারে দুটি উইকেট নিয়ে জানিয়ে দিলেন ডেথ ওভারে এখন তিনিই সেরা। শেষ উইকেটটা ঝুলিতে পুরেছেন অবশ্য আরাফাত সানি। পাকিস্তান যখন ২৫০ রানে অলআউট তখনও এক ওভারের খেলা বাকি! সমান দুটি করে উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি, সাকিব, রুবেল ও আরাফাত সানি।

বোলিং: মাশরাফি বিন মুর্তজা ১০-০-৪৪-২, তাসকিন আহমেদ ২-০-২২-০, নাসির হোসেন ৭-০-৩৭-১, রুবেল হোসেন ৬-০-৪৩-২, আরাফাত সানি ১০-০-৪৩-২, সাকিব আল হাসান ১০-০-৩৪-২, সাব্বির রহমান ২-০-১৭-০, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ২-০-৯-০।

বোলিং: হাফিজ ৮-১-৩৭-০, উমরগুল ৭-০-৫৩-০, ওয়াহাব রিয়াজ ৬-০-৩০-০, জুনাইদ খান ৭.৩-০-৬৭-২, জুলফিকার বাবর ১০-০-৫৬-০, আজহার আলী ১-০-৭-০। ফল: বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী। সিরিজ: বাংলাদেশ ৩-০ ব্যবধানে জয়ী। ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সৌম্য সরকার। ম্যান অব দ্য সিরিজ: তামিম ইকবাল