চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় গরু-মোষ আসা প্রায় বন্ধ : মাংসের বাজারে প্রভাব

ফাইজার চৌধুরী: বৈধ হোক বা অবৈধ হোক দু পথেই ভারতীয় গরু-মোষ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গার সীমান্ত এলাকা দিয়ে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ভারত থেকে গরু-মোষ আসার যে দুটি করিডোর রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় রুট দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সিপুর সীমান্ত।

মাস তিনেক আগে এ গ্রামে ঘুরে যাওয়া যে কেউ এখন গেলে বুঝতে পারবেন, ভারতীয় অংশের কাদাপানিতে ভরা মেঠোপথের চেহারা আর বর্তমানের সমতল অবস্থা দেখে যে ওপার থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মুন্সিপুর গ্রামের প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে খুঁজে পাওয়া গেলো সীমান্তের ওপার থেকে আসা হাতেগোনা কয়েকটি গরু-মোষ। এ সীমান্তের বেশ কিছু অংশে ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় বেশ কয়েক বছর থেকে ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে প্রচুর সংখ্যক গরু–মোষ এ গ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে যেতো। কোরবানির আগে পশু আসার সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে প্রতি বছর।

Chuadanga Cattle-3

গ্রামে ঢোকার মুখ থেকে শুরু করে প্রায় শূন্যরেখা পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে বসতো গরু-মোষের হাট। স্থানীয় ভাষায় একেকটি পশু জড়ো করার স্থানকে বলা হয় গোঁজ। ক’দিন আগেও যে গোঁজে ঠাঁসাঠাসি করে রাখতে দেখা গেছে অসংখ্য গরু-মোষ। তার সবগুলোই এখন ফাঁকা। অনেকটা হঠাৎ করেই ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রাখাল থেকে শুরু করে গোঁজ মালিক এবং পাইকারী ব্যবসায়ীরা। ঠিক কী কারণে এ আকাল তার প্রকৃত কারণ অনেকাংশেই অজানা মুন্সিপুরে গরুব্যবসার সাথে জড়িতদের।

কয়েকজন জানালেন, বিএসএফ নাকি ওপার থেকে গরু আনতে দিচ্ছে না। কয়েকদিন আগে ২৭টি গরুসহ পাঁচ ভারতীয় রাখাল বিএসএফ’র হাতে ধরা পড়েছে এমনটাই জানা গেলো বাংলাদেশি এক রাখালের কাছ থেকে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই গরু আসা আটকে দিচ্ছে বিএসএফ। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দু চারটে পশু এপারে মুন্সিপুর এলে দাম হাঁকা হচ্ছে আকাশছোঁয়া।

জেলার সবচেয়ে বড় এ গবাদিপশুর করিডোরে আসা সবার একই চিন্তা এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কী হবে? এ গ্রামটির শতকরা ৯০ ভাগ বাসিন্দা কোনো না কোনোভাবে ভারতীয় পশু ব্যবসার সাথে জড়িত। পেটের তাগিদে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন ফেনসিডিল চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ক্রেতার অভাবে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম গরু ব্যবসায়ীদের ভিড়ে এইতো সেদিনও সরগরম থাকা বেশ কয়েকটি হোটেল-রেস্তোরাঁ।

আলমডাঙ্গার কৃষক জামাত আলী আশা করে এসেছিলেন কম দামে একজোড়া হালের বলদ কিনবেন এখান থেকে। ঘণ্টাতিনেক মুন্সিপুর-ঠাকুরপুর ঘুরে কাঙ্ক্ষিত পশু না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাকে।

সীমান্ত পার হয়ে যেসব গরু-মোষ বাংলাদেশে আনা হয় সেগুলোর একেকটি ৫শ টাকা শুল্ক কর পরিশোধ করলেই পেয়ে যায় বৈধতা। এর মাধ্যমে শুধু মুন্সিপুর করিডোর থেকেই প্রতি মাসে গড়ে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। আর গত মাসে আদায় হয়েছে এর চারভাগের একভাগ।

কার্পাসডাঙ্গা গবাদিপশু শুল্ক করিডোরে কাস্টমস বিভাগের ভ্যাট আদায়ের যে অফিস রয়েছে সেখানে গিয়ে গত পাঁচ মাসের রাজস্ব আদায়ের তথ্য নিয়ে দেখা গেলো গত বছরের শেষ দু মাস ও এ বছরের প্রথম তিন মাসে মোট পশু এসেছে ২০ হাজার ৮৯২টি। বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর মাসে বৈধ পথে ভারত থেকে গবাদিপশু এসেছে ৬ হাজার ৩৪৩টি। আদায় হয়েছে ৩১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ডিসেম্বরে ৭ হাজার ৬৩০টি গরু-মোষের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আর চলতি বছর জানুয়ারি মাসে মাসে এসেছে মাত্র ৭৫৪টি গরু-মোষ। আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। গত মাসে (মার্চ মাসে) ঢুকেছে ১ হাজার ৭৯২টি গরু-মোষ। আদায় হয়েছে ৯ লাখ ৭ হাজার টাকা। চলতি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত গরু-মোষ এসেছে সব মিলিয়ে শ চারেক। হঠাৎ করেই ভারত থেকে গরু-মোষ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এমনটাই জানালেন এ অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। করিডোর হয়ে আসা গরু-মোষের হিসাব বিজিবি আর কাষ্টমসের কাছে পাওয়া গেলো দু রকম। বিজিবির খাতায় যদি দিনে ১০টা পশু উল্লেখ থাকে সেখানে ওই একই দিন কাষ্টমস বিভাগের খাতায় সে সংখ্যা ৫-৬টি। হিসেবের গরমিল খুঁজতে গিয়ে মিললো বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য। করিডোর হয়ে আসা পশুর হিসেব বিজিবি করে প্রত্যেকটি পশুর মাথা গুনে আর কাষ্টমস বিভাগে ৫শ টাকা জমা দিয়ে পশুগুলো বৈধতা পাওয়ার পর যে রশিদ দেয়া হয় তার মেয়াদ থাকে ৩ দিন। এ তিন দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট গরু অথবা মোষ বিক্রি করে সেই একই কাস্টমস স্লিপ দিয়ে আরও অন্তত দুটি পশু বৈধ হয়ে যায় চতুর গরু ব্যবসায়ীদের কৌশলে। অর্থাৎ আকালের দিনেও অপতৎপরতা। এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে কাস্টমস স্লিপের মেয়াদ ১ দিন করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত গরুব্যবসায়ীরা।

যে কারণে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ রয়েছে: গ্রামবাসী ও গরু ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, মুন্সিপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু আসতে বাধা দিচ্ছেন বিএসএফ সদস্যরা। সেদেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় কথিত গরু পাচার ঠেকাতে বিএসএফ সদস্যরা এ ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর এ কারণে গত তিন মাসে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় করিডোর দামুড়হুদার মুন্সিপুর গরু হাটে করিডোর দিয়ে গরু-মোষ আসা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গত ১ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশের বাংলাদেশ ঘেঁষা বিভিন্ন সীমান্ত পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি গরু পাচাররোধে বিএসএফকে কড়া নির্দেশ দিয়ে যান। মন্ত্রীর নির্দেশের প্রেক্ষিতেই হঠাৎ করেই কমে গেছে গরু আসার সংখ্যা। বিএসএফ’র চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ীরা অল্প যেসব গরু-মোষ বাংলাদেশের বাজারে আনছেন তার দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ কারণে স্থানীয় বাজারে বেড়ে গেছে গরুর মাংসের দাম। মাস দুয়েক আগে ২৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হলেও এখন তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায়। পয়লা বোশেখের দিনও এ দাম ছিলো অপরিবর্তিত।

এ অচলাবস্থা নিরসনে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি-না অথবা বাংলাদেশে আদৌ গরু ঢুকতে দেয়া হবে না এ ধরনের কোনো বার্তা বিএসএফ’র পক্ষ থেকে এসেছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান বিজিবিএম জানালেন, বিএসএফ’র কাছে বরাবরই গরু আসা অবৈধ ছিলো। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কোন উপায়ে এতোদিন বাংলাদেশে গরু পাঠিয়েছেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সম্প্রতি ভারত থেকে গরু-মোষ আসা অনেক কমে গেছে স্বীকার করে এ বিজিবি কর্মকর্তা আরও জানালেন, করিডোর দিয়ে গরু এলে অবশ্যই তা নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করে দেশের বাজারে নিতে হয়। বিগত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি চোরাইপথে আনা গরু বিজিবির হাতে ধরা পড়েছে। এছাড়া তিনি জানান ,সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশি আটক, নিহত হওয়ার ঘটনা শতকরা ৯৮ ভাগ নেপথ্য কারণ এ গরু ব্যবসা। এ অঞ্চলের অনেক পোল্ট্রি ফার্ম, দেশি গরুর খামার বন্ধ হয়ে গেছে ভারতীয় গরুর দাপটে। চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের জেলার মাংসের চাহিদা মেটাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো এবার চালু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গরু পাঠিয়ে ভারত প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করে। সে দেশের সরকারি সিদ্ধান্তে যদি গরু-মোষ আসা বন্ধই হয়ে যায় তাহলে সে লোকসানের হিসেব-নিকেশ তাদের (ভারতের) অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ সমস্যার সমাধান দু দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ছাড়া আপাতত সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে ভারতীয় গরু না ঢুকলে প্রাথমিকভাবে হয়তো কিছুটা অসুবিধা হবে। তাই বলে বসে থাকলে চলবে না। আমিষের ঘাটতি পোষাতে গরুর মাংসের দাম কমানোসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে এখনই সময় এসেছে স্থানীয় খামারিদের পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারিতে আনা।

বিশেষ করে গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে প্রতি বছরই কোরবানির মরসুম এলে এ অঞ্চলে ভারতীয় গরুর দাপটে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয় গরু মোটা তাজাকরণের সাথে জড়িত কৃষকদের। অনেক দিন ধরেই তারা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, ভারত থেকে অবাধে পশু আসা নিয়ন্ত্রণ করা হোক। বারবার লোকসানে পড়ে পুঁজি হারাতে বসা এ দেশীয় গরুর খামারিরা এবার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশে গরু তথা গোমাংসের চাহিদা পূরণে তারাই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে।