১৭ জেলায় ২০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণ সঞ্চারের লক্ষ্যে সরকার কুষ্টিয়াসহ দেশের ১৭ জেলায় ২০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরসহ আগামী তিন বছরে ১৩টি ইজেড প্রতিষ্ঠার জন্য আগামী তিন অর্থবছরে জমি অধিগ্রহণ বাবদ সাত হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। ১৪ হাজার ৬১৯ একর জমির ওপর এই ১৩টি ইজেড প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার মধ্যে পাঁচ হাজার ১২৭ একর জমির মালিক সরকার এবং ৯ হাজার ৪৯২ একর জমি বেসরকারি মালিকানাধীন। এর মধ্যে তিনটির জমি অধিগ্রহণে চলতি অর্থবছরই বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল) থেকে ঋণ নিয়ে বরাদ্দ দেবে সরকার। বাকি ১০টি বাস্তবায়ন করা হবে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। এই ১৩টির মধ্য থেকে ৮৪৩ একর জমির ওপর আনোয়ারা-২ এবং সাত হাজার ৭১৬ একর জমি নিয়ে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে তা দেওয়া হবে চীনা বিনিয়োগকারীদের। ফলে চীনা বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমার থেকে তাদের হিস্যার গ্যাস এনে শিল্পে ব্যবহার করতে পারবে। আর গাজীপুরের শ্রীপুরে ৫১০ একর এবং নরসিংদী সদর উপজেলায় ৬৯০ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠার পর অর্থনৈতিক অঞ্চল দুটি জাপানি বিনিয়োগকারীকে দেয়া হবে।

এছাড়া ভারত, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডসহ আশিয়ানভুক্ত অন্য দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের জন্যও আলাদাভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ ১৩টির বাইরে বাকি সাতটির মধ্যে তিনটি বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি খাত বিজিএমইএ, আবদুল মোনেম লিমিটেড এবং একে খান অ্যান্ড কোম্পানি একটি করে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর যত্রতত্র শিল্প-কারখানা স্থাপন করার সুযোগ দেবে না সরকার। তখন বিনিয়োগকারীদের এসব অঞ্চলেই বিনিয়োগ করতে হবে বলে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রী ও সচিবকে নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সরকারের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতে কোন কোন জেলার কোথায় কোথায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১৫ হাজার একর জমির ওপর মাল্টিপ্রডাক্ট মাল্টিপল অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে চীন, থাইল্যান্ডসহ আশিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশ বিনিয়োগ করতে পারবে। এসব বাস্তবায়ন হলে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে সরকার।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) জানায়, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি চীন ও জাপানের বিনিয়োগকারীদের কথা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে সরকার। কারণ, জাপান ও চীনের সরকার এবং বিদেশি সহায়তাকারী সংস্থাগুলো সরকারিভাবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর চীন ও জাপান সফরের সময় দুই দেশের সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও একই ধরনের আগ্রহের কথা জানানো হয়েছে। সে অনুযায়ী, জাপানি সংস্থা জাইকা ও চীনা বিনিয়োগকারীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় অথনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য সমীক্ষা চালিয়েছে। প্রাক-সমীক্ষায় জাইকা গাজীপুর ও নরসিংদী জেলায় দুটি স্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেজাকে জানিয়েছে। একইভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্থাপিতব্য টানেলের শেষ প্রান্তে কাফকোর অদূরে আনোয়ারা উপজেলায় চায়নিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (সিইআইজেড) স্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানিয়েছে। ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে এ কাজে মনোনীত করেছে। অন্যদিকে ভারত সরকারও তার দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য প্রাথমিক যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করেছে। তবে তারা কোন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব দেয়নি।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিশেষত চীন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি পাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের শুধু জমি ও উপযোগ (গ্যাস-বিদ্যুত, পানি, সড়ক অবকাঠামো ইত্যাদি) সুবিধা দেয়া হবে। ইতঃপূর্বে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হয়েছিলো। বর্তমানে আরো বেশি অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয় বিবেচনা করতে হবে। তবে যথাসম্ভব কৃষিজমির ব্যবহার কম করে অকৃষি জমি ও পুনরুদ্ধার হওয়া জমির ওপর বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক শিল্পাঞ্চল স্থাপন করা হবে। চলতি অর্থবছরসহ আগামী তিন অর্থবছরে ১৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় কেস টু কেস ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে অর্থায়ন করতে নির্দেশনা দেন তিনি।

১৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তম অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠা হবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সাত হাজার ৭১৬ একর জমির ওপর প্রস্তাবিত এই অঞ্চলে বেসরকারি খাতের জমি পাঁচ হাজার ৬০০ একর, বাকি জমি সরকারের। এসব জমি অধিগ্রহণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৩০ কোটি টাকা ও পরের অর্থবছরে এক হাজার ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবে সরকার। এটি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ তৈরির পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করতে হবে। আর নীলফামারী অর্থনৈতিক অঞ্চল যাতে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণে কোনো বাধা না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, নীলফামারীর প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকাটি সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার দূরে। বিমানবন্দর ও প্রস্তাবিত অঞ্চলের মধ্যে সৈয়দপুর শহর অবস্থিত। তাই বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এ অঞ্চল কোনো বাধা হবে না।

এ প্রসঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বেজা কর্তৃপক্ষের নির্বাহী কমিটির সচিব পবন চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি বেজার অনুকূলে হস্তান্তর হয়েছে। মৌলভীবাজার অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। মিরসরাই উপজেলায় প্রতীকী মূল্যে ৯০০ একর খাসজমি বেজার অনুকূলে বন্দোবস্ত দেওয়ার ফাইল প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন।

এ ১৩টির বাইরে সরকারি অর্থায়নে মানিকগঞ্জের পুরাতন আরিচা ফেরিঘাটের অব্যবহৃত জমিতে একটি, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, কুমিল্লার ময়নামতি ও পটুয়াখালীতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করবে সরকার। আর বেসরকারি উদ্যোগে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় একে খান অ্যান্ড কম্পানি লিমিটেড, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বিজিএমইএ ও আব্দুল মোনেম গ্রুপ একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে। ইতিমধ্যে বিজিএমইএর জমি অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। একে খান অ্যান্ড কম্পানিকে প্রাক-যোগ্যতা সনদ দেওয়া হয়েছে। আব্দুল মোনেমকেও সনদ দেওয়া প্রক্রিয়াধীন।

এসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ভূমি অধিগ্রহণে অর্থ বরাদ্দ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া অর্থ বিভাগের পক্ষে সম্ভব হবে না। ঋণ গ্রহণ অর্থ জোগানের একটি মাধ্যম হতে পারে।

প্রস্তাবিত ২০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১৭টির স্থান চূড়ান্ত করেছে প্রাথমিক স্থান নির্বাচন কমিটি। সেগুলো হলো গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী, হাজীগাঁও, বৈরাগ ও বেলচূড়া মৌজা, জামালপুর সদর উপজেলার রঘুনাথপুর দিঘুলী, হরিদ্রাহাটা, গান্ধাইল, জোয়ানের পাড়া, ছোনটিয়া ও সুলতাননগর, নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁ থানার মোহনপুর, নিশং, শুভরকরদি, ঘারমাড়া, মদনগঞ্জ, শম্ভুপুরা ও নয়াচর। এছাড়া ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম চরকালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর, তালশহর ও বাসুতারা, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা, দাড়ারহাট ও প্রধানপুর, নরসিংদী সদর উপজেলার বাগহাটা, বালুসাইর, মহিষাশুর ও খাটরা, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শিবালয়, ঝিকুটিয়া, নেহালপুর ও তালুকসাদুল্লা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার চর মোকারিমপুর, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জলিরপাড়, কোদালধোয়া ও পয়সা এবং নীলফামারী সদর উপজেলার সুবর্ণখুলী ও কাদিখোলা মৌজা। আর বেসরকারি মালিকানাধীন তিনটি অঞ্চল হলো নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কাজৈর, ডাঙ্গা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় চর বাউশিয়াতে আব্দুল মোনেম ইপিজেড এবং একই জেলার বাউশিয়ায় বিজিএমইএর গার্মেন্ট শিল্প পার্ক। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে জলাধার বা লেক (খাল) থাকবে, যাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যাবে। শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্লান্ট থাকবে এবং প্রয়োজনে বনায়ন করতে হবে। লেকের পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্টের মাধ্যমে খাবার পানিতে পরিণত করা যাবে। শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থাও থাকবে।