বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসন্ন সিটি করপোরেশন : উভয়পক্ষই চ্যালেঞ্জে

স্টাফ রিপোর্টার: বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেন দু পক্ষকেই জিততে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও এটি এখন জাতীয় নির্বাচনের অন্যতম ব্যারোমিটার হিসেবে রূপ লাভ করেছে।

সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, এ নির্বাচনে যে পক্ষ জয়ী হবে, অর্থাৎ তিন সিটিতে যার সমর্থিত প্রার্থী জিততে পারবে সেই দলই হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির মাঠের প্রধান ক্রীড়ানক। অন্তত ঢাকার দুটি আসন যে দল ছিনিয়ে নিতে পারবে রাতারাতি সে দল হয়ে যাবে জননন্দিত। তবে এক্ষেত্রে সরকারের জন্য পরীক্ষাটা একটু ভিন্ন। সরকারকে একদিকে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করার প্রমাণ করতে হবে, অপরদিকে জয়ের সুসংবাদটিও নিজেদের ঘরে তুলতে হবে। কেননা, এ নির্বাচন যদি সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ দৃশ্যত প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে সরকারকে দেশে ও বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। বিপরীতে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা যদি জয়ের মুকুট পরতে পারেন তবে তা হবে পোয়াবারো। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের গত প্রায় তিন মাসের আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা যুক্ত হবে। সবার কাছে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, সরকারের ওপর জনসমর্থন কমে গেছে। সরকারের অন্যতম চালিকাশক্তি প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও পড়বে। একইসঙ্গে সুশীল সমাজসহ বিদেশি কূটনৈতিকদের কাছে বিএনপির আন্দোলন যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হবে। বাস্তবে পরিস্থিতি সে রকম হলে সিটি নির্বাচনের পর রাজপথে বিরোধী জোটের সরকার পতনের আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। এদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কয়েকজনের কাছে এ প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে তারা রাজনীতির এমন অংকের সঙ্গে অনেকটা একমত পোষণ করেন। তবে তারা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চাননি। অবশ্য আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, বিএনপি যতটা সহজে এ বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে তা শুধুই স্বপ্ন। বাস্তবে কখনও প্রতিফলিত হবে না। কেননা, আন্দোলনের নামে তারা গত কয়েক মাসে যেভাবে সাধারণ মানুষকে আগুন ও পেট্রলবোমা দিয়ে হত্যা করেছে, চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে তাতে বেশিরভাগ সচেতন মানুষ তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এসব মানুষের কাছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট একটি সন্ত্রাসী জোটে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের এ নেতার এমন যুক্তি মানতে নারাজ বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য। তিনি বলেন, সরকার আসলে ভোটারদের খবর জানে না। প্রশাসনের কিছু চাটুকারের পাল্লায় পড়ে জনগণের সমর্থনকে তোয়াক্বা না করে জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে। কিন্তু স্বৈরাচারী এ সরকারের নানা নিপীড়ন ও ভয়ে মানুষ মুখ খুলছে না। শুধু ভোটের অপেক্ষায় আছে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নয়, এখন থেকে সব ধরনের নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের ভরাডুবি হবে। তবে শর্ত হল, মানুষকে নির্বিগ্নে ও নির্ভয়ে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এই নেতা জোর দিয়ে এ-ও বলেন, মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ সরকার একদিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার লড়াইয়ে বিদ্যমান অবস্থায় আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনটি হয়ে উঠেছে দুই পক্ষের জন্যই যেমন অগ্নিপরীক্ষা, তেমনি অস্তিত্বের লড়াইও বটে। সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি জয়ী হয়ে বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ খণ্ডন করতে হবে। অন্যদিকে তিন সিটিতে জয়ী হয়ে বিএনপিকেও প্রমাণ করতে হবে তাদের দাবি সঠিক, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণ নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার বলেন, বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের পর এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটি অগ্নিপরীক্ষা। সুষ্ঠু নির্বাচন করবে বলে সরকার যে দাবি করছে, তা তাদের এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। পাশাপাশি আসলে তাদের মধ্যে কোন দল কতটুকু জনবিচ্ছিন্ন, তা জনগণের ভোটের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে।

গত দু দিনে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারাও তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অস্তিত্বের লড়াই কিংবা অগ্নিপরীক্ষা হিসেবেই মনে করছেন। বিএনপিকে টানা অবরোধ থেকে ফেরাতে এ নির্বাচনই একমাত্র পথ- এমন ভাবনা দলের নীতিনির্ধারকদের। তাই জনগণকে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে সরকার নির্বাচনে স্বচ্ছতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনের পরিণতি নিয়েও আশংকায় রয়েছে দলটির শীর্ষ মহল। পরাজয় হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দাবি প্রমাণিত হবে- এ ভয়ও রয়েছে তাদের। শাসক দল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব জানা গেছে।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ করে আসছেন। তারা দাবি করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট তিন মাস ধরে টানা অবরোধ ও দু’একদিনের বিরতি ছাড়া হরতালের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এ আন্দোলনে শতাধিক সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। যার বেশিরভাগ পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে। কিছু ক্রসফায়ারের ঘটনায় আন্দোলনকারী বিএনপি-জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীও নিহত হয়েছেন। গুমের অভিযোগ তো আছেই। ওদিকে নাশকতার মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশি-বিদেশি মহল শুরু থেকেই সরকার ও বিরোধী পক্ষের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। সংকট নিরসনে সরকার বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, পেট্রোলবোমা দিয়ে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের সাথে কোনো আলোচনা হবে না। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিছুটা নমনীয় মনোভাব পোষণ করে সঙ্কট থেকে বের হওয়ার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বিএনপি নেত্রীর এ আহ্বানের পর সরকার সরাসরি সাড়া না দিলেও সিটি নির্বাচনের আয়োজন করে পরোক্ষভাবে দলটিকে এক্সিটের পথ করে দিয়েছে। তবে নির্বাচন কতখানি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়ে বিএনপি শিবিরে কিছুটা সংশয়ও রয়েছে। তা সত্ত্বেও এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সমর্থক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীসহ তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আগ্রহের কোনো কমতি নেই।

একদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, অন্যদিকে জয়ী হয়ে বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ খণ্ডন করার চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য অগ্নিপরীক্ষাই কিনা, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন শুক্রবার বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে বিএনপি সর্বশেষ অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতো না। তিনি দাবি করেন, আমাদের সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আর আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন নয়, জনবিচ্ছিন্ন হল বিএনপি। এ কারণেই তারা জনগণকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে আগুন ও পেট্রোলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

এদিকে বিএনপিও সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। এজন্য বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট তিন সিটিতে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের মুখ দেখাতে এ নির্বাচনকে রীতিমতো বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে দেখছে। চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে ভোটের মাঠে নামার সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করেছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও এর ফল দেশে-বিদেশে দু দলের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে। এই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করলে সরকার নানামুখি চাপে পড়বে, যা আগামীতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারায় মানুষের মনে ক্ষোভ জমে আছে। সরকার যেভাবে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে তাতে করে তারা ব্যালটের মাধ্যমে এর জবাব দিতে মুখিয়ে আছে। সিটি নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যাবে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, যে কোনো নির্বাচনকেই বিএনপি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। জনগণ তাদের সঙ্গে আছে এটা অতীতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকার জনগণের রায় ছিনিয়ে নেয় কিনা এটাই এখন আশংকা।