স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকহারে বাড়ছে। পরবর্তীতে অনেক সময় এদের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। বিবিসি থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো। প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশে প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পরবর্তীতে অনেক সময় এদের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়, দীর্ঘদিন পর অনেককে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারও দেখানো হয়। আর অনেকের শেষ পর্যন্ত কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না। এ নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে সাধারণ অপরাধী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে বাসার সামনেই গাড়ি থেকে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার চালককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পরের তিন বছরে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর প্রায় তিন বছর পর, ২০১৪ সালের ১০ মার্চ উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বিএনপির আরেকজন শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দু সপ্তায় তারও কোনো হদিস মেলেনি।
সরকারি বাহিনীগুলো আদালতে জানিয়েছে যে, তারা কেউই মি. আহমেদকে আটক বা গ্রেফতার করেনি। কিন্তু তার স্ত্রী, হাসিনা আহমেদ বলছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই যে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে, তা নিয়ে তার সন্দেহ নেই। হাসিনা আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, ভবনটির দারোয়ান, নিরাপত্তা প্রহরী, সবাই বলেছে, ডিবি পুলিশের লোকজন, প্রশাসনের লোকজন আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। উত্তরার যে বাসাটি থেকে মি. আহমেদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেই বাড়ির বাসিন্দা বা আশেপাশের কেউই আর এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১১১ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। আর আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসেবে, শুধুমাত্র ২০১৩ আর ২০১৪, এ দু বছরে এভাবে ১৬০ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এদের অনেককে পরবর্তীতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
প্রথমে আটকের কথা অস্বীকার করলেও, কাউকে আবার পরে থানায় বা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগেরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর বিষয়ে আদালতে মামলা করা হলেও, তাতে কোনো সুরাহা পায়নি তাঁর পরিবার।
মি. আলীর আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বিবিসিকে বলছেন, ইলিয়াস আলীর বিষয়ে আমরা হাইকোর্টে মামলা করেছিলাম। কিন্তু রাষ্ট্রই যদি জড়িত থাকে, আদালতের আর করার কতোটুকু থাকে? তারা বলেছে, তারা ইলিয়াস আলীকে গ্রেফতার করেনি, তিনি তাদের কাছে নেই। তারা আর তদন্ত করেছে কি-না, আমরা তাও জানি না। তারা জাস্ট সিটিং অন ইট।
বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর, এসব অভিযোগে থানা পুলিশও সহজে মামলা বা সাধারণ ডায়রি নিতে চায় না। কয়েক দিন আগেই ডিবি পুলিশের পরিচয়ে রুমা খাতুনের স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলছেন, থানায় বিষয়টি জানিয়ে মামলা করতে চাইলেও, পুলিশ সাধারণ নিখোঁজের একটি জিডি নিয়েছে।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে গুম করার অভিযোগ করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তবে এরকম অভিযোগ নাকচ করে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা পুরোপুরি আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করেন। ধরে এনে আটকে রাখার যেসব অভিযোগ করা হয়, বাস্তবে এমন কোনো ঘটনা ঘটে না।
ঢাকার পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বিবিসিকে বলছেন, পুলিশ আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করে। কাউকে আটক করা হলে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। পরবর্তীতে প্রয়োজনে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু ধরে এনে গুম করা, এর সাথে পুলিশ জড়িত নয়। এরকম অভিযোগ পেলে পুলিশ সবসময়েই তদন্ত করে। তবে অনেক সময় রাতারাতি তার ফলাফল পাওয়া যায় না।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেবে, এ বছরের প্রথম দু মাসেই ২১ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, পরে তাদের পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে আর দশজনকে থানায় সোপর্দ করেছে। বাকিদের কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করেছেন মানবাধিকার কর্মী নুর খান। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, এরকম ঘটনা নতুন না হলেও, সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মীরা এর শিকার হতে শুরু করেছে।
নুর খান বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে আগে, আমরা শুনেছি, হয়তো নেয়ার দু দিন পর তাকে হাজির করে বলছে, আমরা একদিন আগে আটক করেছি। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও, সম্প্রতি দেখছি, রাজনৈতিক কর্মীরাও এর শিকার হচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের কর্মীরা, কখনো কখনো সরকারি দলের কর্মীরাও এর শিকার হচ্ছেন।
মি. খান বলছেন, রাষ্ট্রের সম্মতিতেই, এ ধরনের অপহরণ হচ্ছে বলে এর কোনো বিচার হয়না, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারও কোনো প্রতিকার পায় না। ধরে নিয়ে আটকে রাখার অভিযোগ উঠছে ৱ্যাবের বিরুদ্ধেও। সাধারণত এরকম অপহরণের শিকার পুরুষরা হলেও, প্রথমবারের মতো গত ১৪ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে দুজন নারীকেও নিরাপত্তা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দু মাসেরও বেশি সময় ধরে তাদের আর কোনো হদিস নেই।
নিখোঁজ একজন নারী, স্থানীয় একটি স্কুলের দপ্তরি নুর নাহারের মেয়ে, সুমি বলছেন, আটকের পর স্থানীয় র্যাব অফিসে গিয়ে তিনি একদিন দেখাও করে এসেছিলেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, তিনি বাহিনীর কাছে নেই। কোথায় আছে, তাও তারা জানে না। তবে কাউকে ধরে নিয়ে আটকে রাখার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলছেন, র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এরকম অভিযোগ করা হয়।
কর্ণেল জিয়াউল আহসান বিবিসিকে বলছেন, আমি মনে করি, র্যাবই একমাত্র সংস্থা, যারা সকল সময় মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে। তবে অনেকে র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এরকম অভিযোগ করে। অনেকে নিজেরা আত্মগোপনে থেকে অপরাধ করে, পেট্রোলবোমা মারে আর উল্টো র্যাবের ওপর দোষারোপ করে যে তাদের নাকি গুম করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, র্যাবের ওপর যে ম্যান্ডেট, তার আইন আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই র্যাব সর্বদা কাজ করে।
বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। তবে বন্দুকযুদ্ধের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনা তদন্ত করলেও, সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানোর মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কমিশনই বলছে, আইনই তাদের হাত-পা বেধে দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুমের কোনো অভিযোগ তদন্তেরই তাদের ক্ষমতা নেই।
কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বিবিসিকে বলছেন, আমাদের আইনেই বলা হয়েছে, ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আমরা তদন্ত করতে পারবো না। তাই গুমের বা নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোন অভিযোগ আমরা এখনো তদন্ত করতে পারিনি। কারণ সেগুলো তদন্তের মতো সক্ষমতাও আমাদের নেই, আবার আইনী সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তবে বন্দুকযুদ্ধের কিছু ঘটনা আমরা তদন্ত করে সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে তারা জবাব দিয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। আসলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করারও থাকে না।
পরিবারের সদস্য নিখোঁজ বা গুমের শিকার হলে, মানসিক টানাপড়েন ছাড়াও, পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদি আইনি জটিলতার মধ্যে পড়ে যার সহজে সমাধান হয় না। বিশেষ করে উত্তরাধিকার বিষয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়।
পরিবারগুলোর মধ্যেও বছরের পর বছর আশা কাজ করে, হয়তো একদিন তাদের স্বজন ফিরে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই আশা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয় না।