টাইগারদের সামনে ভারত : স্বপ্ন জয়ের হাতছানি

স্টাফ রিপোর্টার: আকাশ কি আজ মেঘলা থাকবে? সূর্য কি বিলম্বে মুখ দেখাবে? অনেক কিছুই হতে পারে আজ! বৃষ্টি হতে পারে, রোদ উঠতে পারে; কিন্তু একটা ব্যাপারের ব্যত্যয় ঘটবে না। আজ বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ এক স্বপ্ন নিয়েই ঘুম থেকে  জেগে উঠবে! আর সেটা হলো- ভারতকে হারিয়ে ইতিহাসের আরেক প্রাচীর ধসিয়ে দেয়ার স্বপ্ন! বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জড়তা কাটিয়ে ফেলেছে। প্রথমবারের মতো আজ জাতীয় ক্রিকেট দল খেলছে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে। এবার ইতিহাসের আরও একটা ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পালা, সেমিফাইনালে ওঠার পালা। এই সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন নিয়েই আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় দুনিয়ার সবচেয়ে নামি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভারতের মুখোমুখি হবে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। এমন সুখস্মৃতি কখনোই ধূসর হওয়ার নয়। ১৭ মার্চ, ২০০৭। পোর্ট অব স্পেনে রূপকথার এক জয়ে বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলো বাংলাদেশ। এরপর ২২ গজে যতোবার দেখা হয়েছে দু দলের, প্রতিবারই ফিরে এসেছে ২০০৭ সালের স্মৃতি। এবারও আসছে। মেলবোর্নে কি আজ পোর্ট অব স্পেনের সেই মায়াবী রাত ফিরিয়ে আনতে পারবে বাংলাদেশ? ২০০৭ নিয়ে সমর্থকরা যতোই উৎসাহী হোন, স্মৃতির ভেলায় চড়ে আট বছর আগে ফিরে যেতে একদমই আগ্রহী নন অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আরও বড় কিছুর স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ভারত যেখানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, সেখানে এই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে পা রেখেছে বাংলাদেশ। অতীতে বাংলাদেশের সব স্মরণীয় জয়ই অঘটন হিসেবে চিত্রিত হয়েছে বিদেশী গণমাধ্যমে। কারণ, ছোট দলের তকমাটা এখনও জড়িয়ে আছে টাইগারদের গায়ে। আজ মেলবোর্নে ভারতের বিপক্ষে শেষ আটের লড়াইয়ে দারুণ কিছু করে বিশ্ব দরবারে নিজেদের বড় দল হিসেবে প্রমাণ করতে চান মাশরাফি। সাফ বলেছেন, বাংলাদেশ জিতলে নয়, বরং হারলেই সেটা হবে অঘটন। আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁতে চাইলে শুধু এমন কথা বলা যায়।

এ ম্যাচটিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ বললে ভুল হবে না। বিশ্বসেরার মুকুট উঁচিয়ে ধরতে চাই আর মাত্র তিনটি জয়। এটা যেমন ভারতের জন্য সত্য, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও। বাংলাদেশের লক্ষ্যই ছিলো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা। সেটি পূরণ হয়েছে। সেই সাথে বড় হয়েছে স্বপ্নের আকাশ। তাতে সামর্থ্যরে মেঘ ভাসলে আরেকটি স্বপ্নপূরণের সূর্য উঠতেও পারে। বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে ভারতের বিপক্ষে হারানোর কিছু নেই টাইগারদের। গ্র“পপর্বের মতো ভয়ডরহীন চৌকস ক্রিকেট খেলতে পারলে বরং বাংলাদেশের ক্রিকেট পৌঁছে যাবে অন্য এক উচ্চতায়। কাগজে-কলমে অবশ্যই বাংলাদেশের চেয়ে ঢের এগিয়ে ভারত। গ্র“পপর্বে ছয় ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে অলআউট করে ছয় জয় পেয়েছেন ধোনিরা। আÍবিশ্বাসের তুঙ্গেই আছেন তারা। ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ নিঃসন্দেহে বিশ্বসেরা। তবে দু’দলের ব্যবধান এখন আর আকাশ-পাতাল নয়। শুধু আবেগ নয়, যুক্তিও বলছে বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনা আছে। এটা যেমন পাড়সমর্থকদের প্রত্যাশা, তেমনি সাবেকদের কথা।

ভারতের বিপক্ষে আগের ২৮ ওয়ানডেতে তিনটি জয় রয়েছে বাংলাদেশের, যার শেষ দুটি স্বাধীনতার মাস মার্চেই। তিন জয়ের চার নায়ক মাশরাফি মুতর্জা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল এবারও আছেন দলে। নিজেদের একশ’ ও দেড়শ’তম ওয়ানডেতে ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ভারতের বিপক্ষেই ৩০০ ওয়ানডের মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছেন মাশরাফিরা। এবার আসা যাক পারফরম্যান্সে। উদ্বোধনী জুটিতে রান না এলেও বাংলাদেশের মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা দারুণ ফর্মে আছেন। ভারতের যেকোনো ব্যাটসম্যানের চেয়ে এই বিশ্বকাপে বেশি রান করেছেন মাহমুদউল্লাহ। পাঁচ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরিতে ৩৪৪। এক ম্যাচ বেশি খেলেও মাহমুদউল্লাহর পেছনে আছেন ভারতের শিখর ধাওয়ান (৩৩৭) ও বিরাট কোহলি ৩০১। মাহমুদউল্লাহর পাশাপাশি রানের মধ্যে আছেন মুশফিক, সাকিব, সৌম্য ও সাব্বির। ধোনির মতো মাশরাফিও দলকে সামনে থেকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। এ বিশ্বকাপে ভারতের পেসাররা সবাইকে চমকে দিয়েছে। তবে ক্রিকেটীয় মানদণ্ডে মাশরাফি, রুবেল ও তাসকিনের চেয়ে সামি, যাদব, মোহিতদের খুব বেশি এগিয়ে রাখা যাবে না। একইভাবে সাকিবের চেয়ে ভালো স্পিনার নন অশ্বিন। এছাড়া সাকিবের মতো সত্যিকারের কোনো অলরাউন্ডার নেই ভারতের। সবমিলিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার চাপ এবং মেলবোর্নে ৯০ হাজার দর্শকের সামনে খেলার চাপ সামলাতে পারলে আরেকটি দারুণ জয় আশা করাই যায়। অস্ট্রেলিয়ার ফ্যাশনের রাজধানী মেলবোর্নে আজ ফ্যাশনেবল ক্রিকেট খেলে মাশরাফিরা লাল-সবুজ ঢেউ তুলবেন, এই প্রত্যাশা গোটা দেশের। বারুদে ঠাসা ভারতের ব্যাটিং লাইনআপকেই সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করছেন মাশরাফি। বিশেষ করে ধোনি ও কোহলিকে। কাল মেলবোর্নে প্রাক-ম্যাচ সংবাদ সম্মেলনে ভারতকে অলআউট করাকেই কঠিনতম চ্যালেঞ্জ বলে মেনে নিলেন মাশরাফি, ‘ধোনি সত্যিকারের একজন ম্যাচউইনার, বিরাট কোহলিও। আসলে ভারতের পুরো ব্যাটিং-অর্ডারই বিশ্বসেরা। এটাই আমাদের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ। ভারতের ব্যাটসম্যানদের আউট করতে অবশ্যই খুব ভালো বল করতে হবে আমাদের।

২০০৭ থেকে অনুপ্রেরণ না খুঁজলেও নতুন রূপকথা লেখার রেসিপিটা জানিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি, ২০০৭-এর জয় কিংবা ২০১১-এর হার আমাদের কোনো সাহায্য করবে না, যা করার মাঠেই করতে হবে। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড বা অন্য ম্যাচগুলোর মতোই ভালো ব্যাট করতে হবে। ফ্লাট উইকেটে হাই স্কোরিং ম্যাচ হতে যাচ্ছে। বোলারদের কাজটা তাই বেশি কঠিন হবে। নকআউট ম্যাচে নির্দিষ্ট দিনের পারফরম্যান্সের ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। আশা করি, ভালো একটি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে তার সফল বাস্তবায়ন করতে পারবো আমরা।

মেলবোর্নে আজ বিকেলের দিকে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, নকআউট পর্বের সব ম্যাচের জন্যই রিজার্ভ-ডে আছে। বৃষ্টির চেয়ে বাংলাদেশের ভাবনাতেই বেশি আচ্ছন্ন ভারতীয় ব্যাটসম্যান সুরেশ রায়না, ‘আমাদের আসল বিশ্বকাপ শুরু হবে আগামীকাল (আজ)। কোনোভাবেই আপনি হালকাভাবে নিতে পারেন না বাংলাদেশকে। ২০০৭ বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপে তাদের কাছে আমরা হেরেছি। জিততে হলে তাই সেরাটাই খেলতে হবে।’ প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এমন সমীহ জাগানো প্রতিক্রিয়ার পর রায়না বাংলাদেশের সামর্থ্যরে প্রশংসা করতেও কুণ্ঠিত হননি। ‘কোয়াটার ফাইনালে ওঠায় আমি বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে চাই, বলেছেন তিনি। রায়না অভিনন্দন জানিয়েছেন শেষ আটে জায়গা করে নেয়ার জন্য। গোটা দেশ মাশরাফিদের অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়ার জন্য উন্মুখ। সেজন্য প্রয়োজন জয়। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এবং নিউজিল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ আরেকটি স্বপ্নপূরণের মোহনায়। অগ্নিঝরা মার্চে আরেকটি ভারত-বধের অপেক্ষা। অপেক্ষা উৎসবের পলাশ-শিমুল ফোটার। লাল-সবুজ আজ আরও গাঢ়। আরও উজ্জ্বল রং। সাকিবরা নিশ্চয় সেই রংকে উৎসবের আবিরে রূপান্তরিত করতে ৯০ হাজার দর্শকের সামনে নিজেদের শতভাগ নিংড়ে দেবেন। ১৬ কোটি মানুষ কায়মনোবাক্যে আজ সেই প্রার্থনাই করবেন।

বাংলাদেশ (সম্ভাব্য): তামিম ইকবাল, ইমরুল কয়েস, সৌম্য সরকার, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম (উইকেটকিপার), সাব্বির রহমান, আরাফাত সানি/নাসির হোসেন, মাশরাফি মুর্তজা (অধিনায়ক), রুবেল হোসেন ও তাসকিন আহমেদ।

ভারত (সম্ভাব্য): শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, আজিংকা রাহানে, সুরেশ রায়না, এমএস ধোনি (অধিনায়ক ও উইকেটকিপার), রবীন্দ্র জাদেজা, আর অশ্বিন, মোহিত শর্মা, উমেশ যাদব ও মোহাম্মদ সামি।