মানুষরূপী শাপদের নিঃশ্বাস যেন চারপাশে

মানুষরূপী শ্বাপদের নিঃশ্বাস যেন চারপাশে। বনের পশুরা তো ক্ষুধা নিবারণের জন্য হামলে পড়ে মানুষের ওপর। বোধ-বুদ্ধি-বিবেকহীন যে পশু তার কাছে মানবিকতা প্রত্যাশার অবকাশ কই! কিন্তু মানুষ কি করে অর্থের জন্য এমন অমানুষ হতে পারে? যে খুনি, সেও তো একজন বাবা, একজন সন্তান! চুয়াডাঙ্গা বুজরুকগড়গড়ি মাদরাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের মোহর আলীর ছেলে। সে ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পর অপহৃত হয়। তাকে হত্যার পর একটি ভুট্টাক্ষেতে লাশ ফেলে রাখে মানুষরূপী জানোয়ারের দল। অপরদিকে সিলেটে এক শিশুকে অপহরণের পর মুক্তিপণের দাবিতে আটকে রাখার পর নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এ হত্যার সাথে পুলিশেরই এক সদস্য জড়িত। হত্যার কথা স্বীকারও করেছে ওই সদস্য। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের ভরসাস্থল, যে রাজনীতিবিদদের কাছে বিপদে-আপদে আমরা ছুটে যাই, তাদেরই কেউ সামান্য অর্থের লোভে এমন হীন কাজ করতে পারে?

মুক্তিপণের জন্য অপহরণের বহু ঘটনা এর আগেও অনেক ঘটেছে এবং কোনো কোনোটির বিচারে অপরাধীদের শাস্তিও হয়েছে। এরপরও এ ধরনের অপরাধ যে কমছে না তার কারণ বহুবিধ। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী নিজেরা প্রভাবশালী কিংবা তাদের থাকে ক্ষমতাবান মহলের শীতল ছত্রছায়া। আদর্শ শিক্ষার অভাব, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক নানা প্রভাবে মানুষ দিন দিন ভোগবাদী, আত্মকেন্দ্রিক ও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে। সেই সাথে কমছে ভালোবাসা, কমছে মমতাবোধ। অল্পে তুষ্ট হওয়ার বদলে সীমাহীন চাহিদা মানুষকে তাড়া করছে। ধনী আরো ধনী হতে চাইছে এবং এ জন্য সততা বিকিয়ে দিতেও তার বাধছে না। তাদের ভোগবাদী আচরণ দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকেও লোভী ও অমিতব্যয়ী করে তুলছে। অবাক হলেও সত্য যে, শিশু অপহরণ ও মুক্তিপণের দাবিতে হত্যার সাথে জড়িত যাদের মুখোশ খুলেছে তাদের অধিকাংশই শিশুর নিকটাত্মীয় বা কাছেরই কেউ। এরা অর্থলিপ্সতায় জড়িয়ে ধরা পড়ার ভয়ে হত্যার মতো অপরাধ করে বসছে। অথচ অপহরণের আগে অর্থলিপ্সতায় অন্ধ হয়ে পড়ছে। কেন? সুপ্তভাবে হলেও এর আড়ালে রয়েছে অপরাধ প্রবণতা। সমাজে অপরাধ বেড়ে গেলে তার লাগাম টেনে ধরার জন্য থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইন আছে, আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক সংস্থা। এরপরও কেন অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, জনসংখ্যা অনুপাতে যা হচ্ছে তা খুব একটা অসহনীয় নয়। এরা কি ভেবে দেখেছেন যে পিতা-মাতা সন্তান হারালেন তাদের অবস্থা। অন্যের অশ্রুতে নিজের উদাসীনতা মানে নিজেদেরই ওই অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়া।

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুস্পষ্ট অবক্ষয় এখন চারপাশে। গুম-খুন-রাহাজানির অনেক নায়ক পুলিশের সামনেই দাপিয়ে বেড়ায়। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন-গুমের পর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা দুরস্ত, বিশ্বাস কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। এরপরও ৱ্যাব-পুলিশই সাধারণ মানুষের ভরসা। অজুহাত নয়, অপকর্মের সহযোগিতা নয়, পুলিশকে পারতে হবে। অপহরণের পর শিশু হত্যা? কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, নৈরাজ্য থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে সমাজ সত্যিকার অর্থেই মানুষরূপী শাপদদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে। ফলে প্রতিটি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। অপহরণের পরে নয়, অপরাধমূলক অপকর্মের উদ্দেশে পা বাড়ানোর সাথে সাথেই অপরাধীকে ধরে আইনে সোপর্দ করতে হবে।