পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার পদ্মায় লঞ্চডুবি : চুয়াডাঙ্গার এক গৃহবধূসহ ৭২ জনের লাশ উদ্ধার

মোস্তফা-৩ লঞ্চ টেনে তুলে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা : হস্তান্তর ৫৭ মৃতদেহ

 

স্টাফ রিপোর্টার: পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে রোববারের লঞ্চ ডু্বিতে নারী-পুরুষ শিশুসহ ৭২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার পুত্রবধূ ডা. নবনিতা পাল টিনা ও মেহেরপুরের হায়দার আলী নামের একজন রয়েছেন। ডা. নবনিতা পাল টিনা চুয়াডাঙ্গা তালতলা তেতুলতলাপাড়ার ডা. শ্যামল কুমার পালের স্ত্রী। তিনিও তার স্ত্রীর সাথে পানিতে পড়েন। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেও স্ত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসক এ দম্পতি তাদের সাড়ে ৪ বছর বয়সী মেয়েকে দেখতে কুষ্টিয়া আড়পাড়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের যাত্রী চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ জেহালার বিপ্লব প্রাণে রক্ষা পেয়ে বাড়ি ফিরে লঞ্চডুবির রোমহর্ষক বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন।

mianikganj pic_221

পাটুরিয়া ঘাটের নিকট পদ্মায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মোস্তফা গতকাল সোমবার ভোরে টেনে তোলা হয়েছে। গত রোববার বেলা পৌনে ১২টায় লঞ্চডুবির পর মাওয়া থেকে ছেড়ে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম রাত বারোটার দিকে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৬৯ লাশের নাম-তালিকা থাকলেও উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ‘সেফ’ নামের উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা এ সংখ্যা ৭২ বলে জানিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের নিকট গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫৭টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১৪ জন শিশু, ২০ জন নারী ও অন্যগুলো পুরুষের লাশ। লঞ্চ থেকে একে একে উদ্ধার হওয়া লাশ আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তরের সময় লোকজনের আহাজারিতে গোটা এলাকায় এক শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিখোঁজদের আত্মীয়রা হন্নে হয়ে স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকা তালতলা তেতুলতলাপাড়ার হরিপদ পাল চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারের একজন ব্যবসায়ী। তার ছেলে ডা. শ্যামল কুমার পাল ঢাকা তেজগাওয়ের নিউরো সাইন্স হাসপাতালে কর্তরত। শ্যামল কুমার পালের স্ত্রী নবনিতা পাল টিনাও চিকিৎসক। ডা. নবনিতা পাল টিনার পিতার বাড়ি কুষ্টিয়া আড়পাড়ায়। এ দম্পতির সাড়ে ৪ বছরের মেয়ে নানি বাড়ি আড়পাড়ায় থাকে। গতপরশু রোববার সকালে মেয়েকে দেখার জন্যই এ দম্পতি রওনা হয়। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া লঞ্চ উঠে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই পানিতে ডুবে যান। ডা. শ্যামল কুমার পাল কোনো রকম প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমরা পানিতে ডুবে গেলে আমাকে ও (ডা.টিনা) উঁচু করে তোলার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ছেড়ে দেয়। আমাকে অন্য একটি লঞ্চেলের যাত্রীরা উদ্ধার করলেও স্ত্রীকে আর উদ্ধার করতে পারেননি। খোঁজাখুঁজি চলতে থাকে। পরে পাওয়া যায় স্ত্রীর মৃতদেহ।

চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের ব্যবসায়ী হরিপদ পালের পুত্রবধূ ডা. নবনিতা পাল টিনার মৃতদেহ গতকাল কুষ্টিয়ায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে। স্ত্রীকে হারিয়ে ডা. শ্যামল কুমার পাল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এদিকে একই লঞ্চ ডুবিতে মেহেরপুরের হায়দার আলী (৫০) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেলেও বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি। এছাড়া মৃতদের মধ্যে কুষ্টিয়ারই ১৫ জন। রাজবাড়ির ১৩ জন বলে জানা গেছে। ফরিদপুরের একই পরিবারের ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকার লঞ্জ ডুবিতে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়া আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ জেহালার মৃত সিরাজুলের ছেলে বিপ্লব বাড়ি ফিরেছেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, একটি বড় ঝাঁকুনি লাগে এবং প্রচণ্ড জোরে শব্দ হয়। একটি ছোট বাচ্চা ছেলে আমার শরীরের ওপর পড়ে। আমি বুঝতে পারি লঞ্চের সাথে কিছু একটার ধাক্কা লেগেছে। লঞ্চটি ডুবে যাচ্ছে। আমি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি জানালার পাশে এসে বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। এ সময় মানুষের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনতে পারি। মানুষের বাঁচার কি যে আকুতি নিজে চোখে না দেখলে বোঝানোর উপায় নেই। প্রচণ্ড স্রোতের মাঝে নিজেকে ছেড়ে দিই। ছেলেটি কোথায় গেলো জানি না। প্রায় দু ঘণ্টা পর একটি কার্গো এসে আমাকে উদ্বার করে। কূলে আমাকে একটি বাসে উঠিয়ে দেয়। আমি কল্পনায় করিনি এমনভাবে বেঁচে যাবো।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানিয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু মানিকগঞ্জের কুমুদ গোশ্বামীর বাড়ি থেকে গুরু সেবা দিয়ে ফেরার পথে পাটুরিয়া-দৌলদিয়া নৌপথে লঞ্চডুবির কবলে পড়ে লাশ হয়ে ফিরলেন ফরিদপুরের সালথার একই পরিবারের চারজন।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের ভটরকান্দা গ্রামের মৃত সুতাশ চন্দ্র নাথের ছেলে বৌধ নাথ সরকার (৬৫), তার স্ত্রী অনিমা রানী (৫৫), বৌধ নাথের ৩ কাকি চম্পা রানী (৬২), অর্চনা রানী (৪২) ও বাসন্তী রানী (৫০) এক সাথে গুরু সেবা দিতে ধর্মগুরু মানিকগঞ্জের কুমুদ গোশ্বামীর বাড়িতে যান। গুরু সেবা দিয়ে রোববার তারা বাড়ি ফেরার পথে পদ্মায় লঞ্চডুবির কবলে পড়ে বাসন্তি রানী ছাড়া বাকি চারজনের মৃত্যু হয় পদ্মায়। সোমবার দুপুরের নিহতদের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হলে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে এলাকার পরিবেশ। শোকবহ পরিবারের সদস্যদের শান্ত্বনা দিতে ছুটে আসেন প্রতিবেশীসহ প্রসাশনের কর্মকর্তারা। বিকালে বাড়ির পাশে নিহতের শেষ সমাধি করা হয়।

শিবালয় দক্ষিণ তেওতার লঞ্চ কর্মচারী আবুল হাসেম হাসু (৫৫), নড়াইল নরাগাতি গ্রামের আলেয়া বেগম (৩২), লোহাগাড়ার শাহেদা বেগম (৬০), রাজবাড়ীর পাংশার আজিরুন্নেছা (৩৮), হালিমা বেগম (৪৫), শাকেরা বেগম (৫০), সদরের রেখা রানী মালাকার (৪৫), ঝিনাইদহ শৌলকুপার মারুফা আক্তার (৫), ঢাকা কদমতলীর বাসিন্দা ব্র্যাক কর্মকর্তা মোস্তফা মণ্ডলসহ (৩৫) ১৫ জন নিখোঁজ রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী নিহতরা হচ্ছে, মানিকগঞ্জের শিবালয়ের ছোট বোয়ালীর অঞ্জলী সূত্রধর (৬০), ষাইটঘরের লঞ্চ কর্মচারী রতন চন্দ্র সরকার (৫২), শিমুলিয়ার হোসাইন (২), লতা (২২), ইন্তাজগঞ্জের আবুল হাসেম (৪৫), দৌলতপুরের ইমরান (৮), বাঘুটিয়ার লাবনী আক্তার মুক্তা (১৫), সেলিম (২২), পাবনা কোলাদী গ্রামের বাসিন্দা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক ফজলুর রহমান খাঁন (৫৫), রাজবাড়ী পাংশার হালিমা বেগম (৪৫), বালিয়াকান্দীর মঞ্জিলা বেগম (৪৫), নাছিমা আকতার (৩৬), এনামুল (১৪), ব্রাহ্মণদীয়ার রাবেয়া বেগম (২৮), গোয়ালন্দের রুমা আক্তার (২৫), উত্সব (৭), নুসরাত নূর (২) ফারজানা আক্তার স্মৃতি (২), সুফিয়া (২৮), নবীজান (৩২), বত্তারপুরের অসিমা রানী (৪০), শিবরামপুরের জয়নাল শেখ (৪০), ছাবেরা (৫০), রহমান (৫৫), কুষ্টিয়ার কমলাপুরের মেহদি হাসান বাপ্পী (৩০), মিলপাড়ার লায়লা (৬), নাসির উদ্দিন (৪০), কুমারখালীর বিথী (১৫), মর্জিনা (৫), ডলি খাতুন (৩৪), ইমন (১), ইদ্রিস (৫০), মধুসুধন সাহা (৬০), খোকসার মোস্তফা (৫৫), এনামূল হক (১৮), ছেঁউড়িয়ার সাবু (২৫), মিরপুরের শরিফ (২৫), আসাদুল (২৮), আরুয়াপাড়ার ডা. নবনিতা পাল টিনা (৩০), ফাতেমা (৪০), নড়াইল নাড়াগাতির আমেনা বেগম (৩৫), হুসাইন ফকির শফি (২৮), কেয়া মনী (৭), হাফছা (৮), ফরিদপুর কোতয়ালীর মমতা বেগম (৪০), নার্গিস (১১), রতন কুমার সরকার (৩৪), পাপন (৫), রেবেকা সুলতানা (৩৩), নগরকান্দার বাঁধন (৫), সালথার চম্পা রানী (৫৮), বৈধ্য নাথ মালো (৫৫), অনিমা রানী মালো (৪৫), অর্চণা (৪৫), বোয়ালমারির শারমিন (২৫), মারজানা (৬), সদরপুরের স্বপন সরকার (৫২), কাশিয়ানীর শাহানাজ (৪৫), মাগুরা শ্রীপুরের লাইলী বেগম (৬৫), গোপালগঞ্জ কাশিয়ানীর জুনায়েদ (১), বনগ্রামের আসলাম মোল্লা (৩৫), আরুয়াকান্দীর রিনা (২৩), কুমিল্লার আব্দুল মোন্নাফের পুত্র আবুল হাসান (৬৫), সুরেন্দ্র ভৌমিকের পুত্র পরিমল ভৌমিক (৪৫), মেহেরপুরের হায়দার আলী (৫০), নীলফামারী দুলাপাড়ার রিয়া মনী (৩), শেরপুর নকলার লিটন (৫০)।

আত্মীয়স্বজনের নিকট লাশ হস্তান্তরের সময় জেলা প্রশাসন ও লঞ্চ মালিকের পক্ষ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় তথ্যের ভিত্তিতে আরো ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনার দিন বিকালে ঘোষণা দেন।