পদ্মায় লঞ্চডুবি : ৪৮ জনের লাশ উদ্ধার : নিখোঁজ অর্ধশত

স্বজনদের আজহারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পদ্মা পাড়ের বাতাস : উদ্ধার কাজ অব্যাহত

 

স্টাফ রিপোর্টার: পদ্মা নদীতে গতকাল রোববার মালবাহী কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমভি মোস্তফা-৩ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে। লঞ্চটি পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া যাচ্ছিলো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শিশু ও নারীসহ ৪৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তখনও প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি নিখোঁজ ছিলেন।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিখোঁজ ব্যক্তি ও লাশের সন্ধানে পদ্মা পাড়ে ভিড় জমিয়েছেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পদ্মা পাড়ের বাতাস। লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আটক করা হয়েছে লঞ্চে ধাক্কা দেয়া মেসার্স দিলরুবা আশরাফ খানের মালিকানাধীন কার্গো নার্গিস ১-এর তিন লস্করকে। তারা হলেন- শাহীনুর রহমান, শহীদুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলাম।

রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলছিলো। দমকল কর্মী, ঢাকা থেকে আসা ডুবুরি দল ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীদের সাথে স্থানীয়রাও সে অভিযানে সর্বস্ব নিংড়ে দিচ্ছিলেন। তবে তখন পর্যন্ত ডুবে যাওয়া এমভি মোস্তফা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মাওয়া থেকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের অপেক্ষায় ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. সামসুজোহা খন্দকার, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশেদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম খান ও পুলিশ সুপার তাপতুন নাসরীন উদ্ধারকাজ পর্যবেক্ষণ করেন।

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশেদা ফেরদৌস জানিয়েছেন, নিহতদের সৎকারের জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। নিহত জনপ্রতিকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ম্যাজিস্ট্রেট সেতাবুল ইসলাম বলেন, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খোলা হয়েছে দুটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

লঞ্চের যাত্রী ব্র্যাক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, পাটুরিয়া লঞ্চঘাট থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে এমভি মোস্তফা-৩ দৌলতদিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে। লঞ্চটি মাঝ নদীতে এলে কার্গো জাহাজটি আমাদের জাহাজের ঠিক মাঝ বরাবর সজোরে ধাক্কা দেয়। মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরাও অনুরূপ তথ্য দিয়ে জানান, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে নার্গিস-১ কাজিরহাট যাচ্ছিলো।

পাটুরিয়া লঞ্চঘাটের সুপারভাইজার জুয়েল রানা জানান, লঞ্চে মাদারীপুরগামী কমফোর্ট লাইনের এক বাসের ৪৩ যাত্রী, একটি লোকাল বাসের ৬০ যাত্রী ও কয়েকজন সাধারণ যাত্রী ছিলেন। লঞ্চডুবির পর ৩৫-৪০ জন যাত্রী সাঁতরে ও কার্গো নার্গিসের সহযোগিতায় তীরে উঠতে সক্ষম হন।

ব্র্যাক কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, তিনি এবং দু সহকর্মী রফিক মিয়া ও মোস্তফা মাহফুজ কুষ্টিয়ায় অডিট কাজে যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর তিনি ও রফিক মিয়া সাঁতরে উঠতে পারলেও মোস্তফা মাহফুজ উঠতে পারেননি। মাত্র ৮-১০ সেকেন্ডের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যাওয়ায় এবং যাত্রীরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরায় অনেকেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উঠতে পারেননি।

তদন্ত কমিটি গঠন: পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমভি মোস্তফা লঞ্চডুবির ঘটনা তদন্তে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. শাজাহানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের স্পেশাল অফিসার মেরিন সেফটি গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান। এছাড়া দুর্ঘটনা তদন্তে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব নূর উর রহমানের নেতৃত্বে ইতিপূর্বে গঠিত স্থায়ী তদন্ত কমিটি এ দুর্ঘটনার তদন্ত করবে। রোববার নৌমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌসচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর একটি কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর নেতৃত্বেও আরও একটি কমিটি গঠন করা হবে। তবে রোববার কয়টি কমিটি গঠন করা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি জানাতে পারেননি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গত বছরের ৮ আগস্ট পদ্মায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ পিনাক-৬। ওই ঘটনায় ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি অর্ধশতাধিক মানুষের।