মৃত্যু পরোয়ানা জারি

স্টাফ রিপোর্টার: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে পরোয়ানাটি কারাগারে পাঠানোর পর সেটি বিকালে পড়েও শোনানো হয়েছে এ আসামিকে। আর এটি পড়ে শোনানোর সাথে সাথে গণনা শুরু হয়েছে রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার) আবেদন দায়েরের ১৫ দিনের সময়সীমা। সে অনুযায়ী ৫ মার্চের মধ্যে তাকে রিভিউ আবেদন করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়ের হলে সেটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করবেন আপিল বিভাগ। এর আগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপি বুধবার প্রকাশিত হয়। এ দিন সন্ধ্যার মধ্যেই রায়ের অনুলিপি পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রায়ের কপিটি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। এরপর রায় প্রদানকারী তিন বিচারপতি ওয়াবদুল হাসান, মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহীনুর ইসলাম মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। বেলা দেড়টার দিকে ট্রাইব্যুনালের জারি করা লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ও আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পৌঁছানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আফতাবউজ্জামান, কোর্টকিপার সঞ্জয় সরকার ও ডেসপাস রাইডার সিরাজুল ইসলাম সেগুলো পৌঁছে দেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কপিটি আইজি প্রিজনের (কারা মহাপরিদর্শক) বরাবরে পাঠানো হয়। এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়েছে মৃত্যু পরোয়ানার অনুলিপি।

বিকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মৃত্যুপরোয়ানা হাতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, রায়ের কপিতে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে, ঠিক সেভাবেই রায় কার্যকর করা হবে। তাকে সব প্রকার আইনি সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হবে। বিকেল সোয়া ৩টায় মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। এ সময় সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী এবং জেলার নেছার আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কারা সূত্র বলেছে, কামারুজ্জামানকে যখন মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয় তখন তিনি চুপচাপ ছিলেন। প্রায় ১৫ মিনিট এভাবে থাকার পর তিনি তার আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। সিনিয়র জেল সুপার সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনরা তার সাথে দেখা করতে পারবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেছেন, মৃত্যু পরোয়ানা হাতে পাওয়ার পরপরই তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি দুজন জল্লাদ ফারুক ও রাজুকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া আইনগত সব প্রক্রিয়া শেষ হলে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি অপর জল্লাদ শাজাহানকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হবে। জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছানোর পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কারাগারের ভেতরেও জেল পুলিশের কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সাথে সাধারণ বন্দিদের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষাতেও আরোপ করা হয়েছে বিধিনিষেধ। যদিও এ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে দাবি করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। ফরমান আলী জানান, কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়টি কারাগারের অন্য বন্দিরাও জানতে পেরেছেন। কেউ যাতে কোনো সুযোগ নিতে না পারে সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

দিন গণনা শুরু: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, যেহেতু কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, সেহেতু তিনি তা জেনে গেছেন। সুতরাং আজ থেকেই রিভিউ আবেদন দায়েরের দিন গণনা শুরু হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্টে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিঙে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, রায়ের সার্টিফাইড কপি বা কামারুজ্জামানকে রায়ের বিষয়টি জানানো- যেটি আগে হবে সেটি অনুযায়ীই তিনি রিভিউ দায়েরের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যদি রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করে, তাহলে তা অবৈধ হবে না। কারণ সুপ্রিমকোর্ট রায়ে এ কথা বলেননি যে, রায় কার্যকরের জন্য রাষ্ট্র প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে না। তবে রিভিউ দায়েরের সাথে সাথেই এ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যাবে। আসামিপক্ষকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে।

রিভিউ না করলেও ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে: মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি কামারুজ্জামান রিভিউ আবেদন না করলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্ট বার অডিটোরিয়ামে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে ১৫ দিন অপেক্ষা নাও করতে পারে- অ্যাটর্নি জেনারেলের এমন বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খন্দকার মাহবুব বলেন, এ বক্তব্য শুনে মনে হয় আমরা হীরক রাজার দেশে বাস করছি। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনের রায়ে বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করা যাবে। তাহলে কি করে রিভিউয়ের ১৫ দিন সময় অতিক্রম হওয়ার আগে ফাঁসি কার্যকর হবে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি, খামখেয়ালি ও আইন কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা। তা না হলে তারা সরকারকে এভাবে পরামর্শ দিতে পারত না। তিনি বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আমরা রিভিউ করবো। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হবে যে, কীভাবে তা কার্যকর হবে। সেখানে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে, নাকি যাবজ্জীবন হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রিভিউ আবেদন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপিলের রায় কার্যকর করা যাবে না। তিনি বলেন, যেই মুহূর্তে আমরা রায়ের সার্টিফাইড কপি পাব, সেই মুহূর্ত থেকে আমরা ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দাখিল করব। আমরা ইতোমধ্যেই সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছি। এখনও পাইনি।

কামারুজ্জামানের এ আইনজীবী বলেন, রিভিউ করার পর রিভিউ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি হবে, শুনানির পরে আবার তার রায় হবে, রায়ের পরে সে রায় কার্যকর হবে। ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করা আমাদের আইনগত অধিকার। মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রচলিত আইনানুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারি করাটা ঠিক আছে। কিন্তু আইনের বরখেলাপ করে পরোয়ানা কার্যকর করতে পারবে না। তিনি বলেন, রিভিউ নিষ্পত্তি করার পরও কামারুজ্জামানকে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা। তিনি যদি ক্ষমা চাইতে রাজি হন, তাহলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় রিভিউয়ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন-১৯৭৩-এ কিছুই বলা নেই। এ কারণে এর আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া একমাত্র আসামি আবদুল কাদেও মোল্লার রিভিউ দায়ের নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দণ্ডিতরা রিভিউ করতে পারবেন কি পারবেন না তা নিয়ে এ বিতর্ক চলে। এ অবস্থায় কাদের মোল্লা রিভিউ আবেদন দায়ের করেছিলেন। রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তা খারিজ করে দেন। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। গত বছরের ২৫ নভেম্বর রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন খারিজের রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয় আপিল বিভাগে। আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ তার ফাঁসি বহাল রাখেন। বুধবার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়।