জীবননগর মহেশপুরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টির পর রাস্তা-ঘাটে বরফের আবরণ

বুধবারের পর বৃহস্পতিবার ভোর রাতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ : উঠতি ফসল ও ইটভাটাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও ঝিনাইদহের মহেশপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় পরশু বিকেলের পর গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতেও ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে সড়কসহ বাড়ি ঘরে বরফের আবরণ স্তূপ আকারে জমে যায়। দৃশ্য দেখে এলাকার প্রবীণদের অনেকেই বলেছেন, স্মরণকালে এ ধরনের শিলাবৃষ্টি দেখিনি আমরা। শিলাবৃষ্টিতে হাজার হাজার হেক্টর জমির উঠতি রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে এ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। হঠাৎ করে শুরু হওয়া ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ঘরবাড়িসহ চলতি মরসুমে ইটভাটায় শিলাবৃষ্টির কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছ।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার শিলাবৃষ্টিতে টিনের ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে এই শিলাবৃষ্টি হয়। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে উপজেলার সীমান্ত ইউনিয়নের কয়া ও বেণীপুর গ্রামে। এদিকে, জেলার ৮০টির বেশি ইটভাটা শিলা বৃষ্টির কারণে ভিজে নষ্ট হওয়ায় প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ইট বিনষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভাটামালিক নেতারা। এতে এলাকার শতাধিক টিনের ঘরবাড়ি এবং মাঠে থাকা গম, মসুর, ভুট্টা, সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, কলা, পান, তামাক, ধনিয়া, আম এবং সজনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ অমল ও কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এলাকাবাসী জানায়, ভোর ৪টা ৫০ থেকে ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত টানা আধাঘণ্টা একটানা শিলা পড়তে থাকে। এরপর শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। প্রবীণ লোকজনেরা জানান, গত ৫০/৬০ বছরে তাঁরা এধরণের শিলাবৃষ্টি দেখেননি। জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, ভোররাতের এই শিলাবৃষ্টিতে উপজেলার কৃষি ফসলের অন্তত ২০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে, চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শিলা বৃষ্টির কারণে চার উপজেলার ৮০টির বেশী ইটভাটা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। যেসব কাঁচা ইট পলিথিন দিয়ে ঢাকা ছিল সেক ইট কিছুটা রক্ষা পেলেও হঠাৎ বৃষ্টির কবলে পড়ে বেশীর ভাগ ইট নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে, ইট নষ্টের কারণে ভাটা মালিকরা যেমন আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন ,তেমনই বাড়ি তৈরিতে ভালো ইট পেতেও ক্রেতাদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লাভলু বলেন, শিলাবৃষ্টির কারণে ইট যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ভাটামালিকরা পড়েছেন বিপাকে। ধারণা করছি প্রতিটি ইটভাটা অন্তত ৭-৮ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে উঠতি ফসলসহ বাড়ি ঘরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। বুধবার বিকেলে ও রাত ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঝড়ে উথলী ও সীমান্ত ইউনিয়নের ২২টি গ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাত ৩টার দিকে শিলাপাতের ঘটনা ঘটলেও ৮ ঘণ্টা পরও গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ৪ ইঞ্চি পুরু শিলার অস্তরণ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান আবু মো. আ. লতিফ অমল ও ইউএনও নুরুল হাফিজসহ সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

শিলাবৃষ্টিতে সীমান্ত ইউনিয়নের কয়া, বেনীপুর, গঙ্গাদাসপুর, মেদিনীপুর, হরিহরনগর, আটপেকে, উথলী ইউনিয়নের উথলী, একতারপুর, সেনেরহুদা, মৃগমারী, দেহাটি, কাশিপুর, খয়েরহুদা, সন্তোষপুর, মনোহরপুর, শিংনগর, রাজাপুর, ধোপাখালী, মানিকদাহ ও আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের কিছু অংশের মাঠের উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।

সীমান্ত ইউনিয়নের কয়া গ্রামের ভুট্টাচাষি মুনসুর আলী জানায়, ব্যাপক শিলাবৃষ্টিতে তার ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। ক্ষেতের সিংহভাগ ভুট্টা গাছ ভেঙে ন্যুয়ে পড়েছে। এছাড়া মসুরি ও আমের মুকুল সব পড়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। ধোপাখালী গ্রামের টমেটা চাষি দরবেশ আলী জানান, তার ৫ বিঘা ক্ষেতের টমেটা শিলাঘাতে মাটির সাথে মিশে গেছে। এ ব্যাপক ক্ষতিতে তিনি দিশেহারা। সীমান্ত ইউপি সদস্য কয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, রাতভর শিলাবৃষ্টিতে এ গ্রামের আবাদি জমির সকল ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ভুট্টা, মসুরি, গম, তামাক, সজনা ও শাক-সবজি শিলার আঘতে নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, এ গ্রামের প্রায় ৬শ হেক্টর আবাদি জমির ফসল শিলাবৃষ্টিতে তছনছ হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এছাড়াও শিলাবৃষ্টিতে বড় বড় বরফের খণ্ডে টিন ও ছনের তৈরি বসতবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় দরিদ্র পরিবার ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার সীমান্তবর্তী বেনীপুর গ্রামে শীলাপাতের কারণে প্রায় ৫শ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

ঝিনাইদহ/মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় দশটি ইউনিয়নে শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমির উঠতি রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফসল হারিয়ে কৃষকরা ভেঙ্গে পড়েছেন। শুধু ফসল নয় প্রাণহানি ঘটেছে দেশীয় প্রজাতির ফিঙ্গে, দোয়েল, শালিক, টিয়ে সহ নাম না জানা হরেক রকম পাখিরও। এছাড়া হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভায়না ইউনিয়নেও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনে কাজ শুরু করেছেন। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি নবী নেওয়াজ সকাল থেকে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তিনি জানান, প্রাথমিক ভাবে ৩৫শ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানালেও ক্ষতির পরিমান দ্বিগুণ হবে।

মহেশপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু তালহা জানান, বুধবার দিবাগত রাত দুইটা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়ন সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর, নাটিমা, মান্দারবাড়িয়া, স্বরুপপুর, মহেশপুর পৌরসভা, বাশবাড়িয়া ও শ্যামকুড় ইউনিয়নে প্রাথমিক তদন্তে চার হাজার হেক্টর জমির ফসল ৯০ থেকে ৯৮ শতাংশ বিনষ্ট হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমান আরো বাড়তে পারে। তিনি বলেন, শিলাবৃষ্টিতে ২৫’শ হেক্টর জমির মশুড়ি, সাতশ হেক্টর জমির গম, তিনশ হেক্টর জমির ভুট্টা ও দুইশ হেক্টর জমির আম বাগানের আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এছাড়া জাম, লিচু, লাউ ও কলাসহ বিভিন্ন তরিতরকারির ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখনো বিভিন্ন গ্রামে শিলার স্তর দেখা যাচ্ছে। ধানের ক্ষেত মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মহেশপুরের শ্যামকুড় মাঠপাড়া গ্রামের মিরন হোসেন জানান, ভোররাতে বৃষ্টির সময় বড় বড় আকারের শিলা পড়ে মাটিতে ৭/৮ ইঞ্চি উঁচু শিলাস্তর জমে যায়। সকাল পর্যন্ত এসব শিলা জমে ছিল। তিনি বলেন, শিলার সঙ্গে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছিল। এতে গম, মসুর, ভুট্টা, কলা, আম, তামাক ও পানের ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। শিলার আঘাতে আমের মুকুল ঝরে পড়েছে। সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক ইমাদুল জানান, ঝড়ে আমার ঘরের টিনের কিছু ক্ষতি হয়েছে। সকালে মাঠে গিয়ে দেখি মসুড়ি ক্ষেত পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। ভালাইপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক আব্দুল কাদের জানান, শিলাবৃষ্টিতে আমার ৩ বিঘা জমির তামাক ক্ষেত পুরোটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমাকের পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসতে হবে। যাদবপুর ইউনিয়নের শফিকুল ইসলাম, ওসমান আলীর গম ভুটা, মসুড়ির ৯ বিঘা জমির ফসল সব নষ্ট হয়ে গেছে। মহেশপুর উপজেলার স্বরুপপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জুলফিক্কার আলী জানান, তার ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। জীবনে এমন শিলা ঝড় দেখেননি বলে তিনি জানান। মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসিমা বেগম জানান, আমি নিজে নাটিমা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরেছি। শিলাবৃষ্টিতে যে ক্ষতি হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তিনি বলেন, গাছগুলো দাড়িয়ে আছে পাতাবিহীন। ফসলের ক্ষেত মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ক্ষতির পূর্ণ বিবরণ সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহ মো. আকরামূল হক জানান।