দামুড়হুদায় দিনকে দিন বেড়েই চলেছে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা

পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যু : আক্রান্ত প্রায় ৮শ : ২ জনের পঙ্গুত্ব বরণ

 

বখতিয়ার হোসেন বকুল: দামুড়হুদা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই দিনকে দিন বেড়েই চলেছে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জীবনঘাতী আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে উপজেলায় এ পর্যন্ত মোট ৪৮ জন মারা গেছেন। দুজন পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করেছেন। আর বর্তমানে প্রায় ৮শ ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি এনজিও সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশ ও রিসো আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি বিনাসুদে ঋণ বিতরণসহ মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। প্রতিমাসেই আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।

দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের বড়দুধপাতিলা গ্রামে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই গ্রামের রিয়াজ উদ্দিনের স্ত্রী জামেলা খাতুনকে (৬৮) প্রথম রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। আর্সেনিকের মরণ ছোবল কেড়ে নেয় তার প্রাণ। দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৯৯৪ সালের ২০ ফেব্রুযারি তিনি মারা যান। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের ১৩ মে ওই গ্রামের সোবাহানের ছেলে আফসার (৭০) এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ২ মার্চ আ. করিমের ছেলে নূর ইসলাম (৪৪) মারা যায়। এরপরই নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য বিভাগ। শুরু হয় রোগী শনাক্তের পাশপাশি চিকিৎসা কার্যক্রম। ওই বছর শুধুমাত্র বড়দুধপাতিলা গ্রামেই শনাক্ত হয় প্রায় দেড় শতাধিক রোগী। চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি ওই গ্রামে বসানো হয় আর্সেনিকমুক্ত পানির প্লান্ট। কিন্তু গ্রামের মানুষের অসচেতনতা আর অব্যবস্থাপনায় অকেজো হয়ে পড়ে থাকে ইউনিসেফ কর্তৃক প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মিত আর্সেনিকমুক্ত পানির প্লান্ট। গ্রামের সাধারণ জনগণ জেনেশুনেই আবারও পান করতে শুরু করে আর্সেনিকযুক্ত পানি। ২০০০ সালে একই রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই গ্রামের রহিমের ছেলে ইব্রাহিম হোসেন (৬২), আনছার আলীর ছেলে আমজাদ হোসেন (৩৫) ও নূর বক্সের ছেলে মাজের আলী (৬৫) মারা যায়। এরপর পর্যায়ক্রমে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওই গ্রামের আরো ৩৫ জন নারী-পুরুষ। শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল।

২০০২ সালে হামিদের স্ত্রী সাদুবানু (৭০), ২০০৩ সালে রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে তৎকালীন ইউপি সদস্য আ. মান্নান (৪৭) ও আব্বাসের স্ত্রী সারজিনা খাতুন (৩৬), ২০০৪ সালে ফজল জোর্য়াদ্দারের ছেলে করিম জোয়ার্দ্দার (৭২) ও রহিমের ছেলে ওদু (৩০), ২০০৫ সালে আজিবারের স্ত্রী রমেছা (৭০), ২০০৬ সালে মইরদ্দির স্ত্রী খোলসা বিবি (৬৫), ২০০৭ সালে ছামাদের ছেলে শফিকুল (৩৫), ২০০৮ সালে জাহাঙ্গীরের ছেলে আনছার আলী (৫৭) ২০০৯ সালে সামাদের স্ত্রী ছালেহা বেগম (৬২) ও রমজান আলীর ছেলে গাজীউর (৫৮), ২০১০ সালে ইসমাইলের ছেলে হায়দার আলী (৬৯), ভোলায় মণ্ডলের ছেলে মইরদ্দিন (৪৫), আজিবারের স্ত্রী খোদেজা খাতুন (৫২), হানেফের ছেলে শহিদুল (৪২) ও কাদেরের স্ত্রী ছুরাতন বিবি (৬৮), ২০১১ সালে হানেফের ছেলে আ. কুদ্দুস (৫২), দেলবারের ছেলে মইরদ্দিন (৭২), রমজান আলীর ছেলে মুনছার আলী (৬৫) ও ফজলুর স্ত্রী জামেনা খাতুন (৪৫), ২০১২ সালে মোজাফ্ফর আলীর ছেলে আ. ছাত্তার (৬২), ২০১৩ সালে হায়দার আলীর স্ত্রী ছফুরা বেগম (৬০), জাহান আলীর ছেলে ছহম আলী (৭৮), দিদার আলীর ছেলে তেতুল বিশ্বাস (৭৫), মন্টুর স্ত্রী রাহেলা বেগম (৪৫), তাহের মণ্ডলের ছেলে দলু মণ্ডল (৬৬), সিফাতুল্লার ছেলে ইসলাম (৬০) ও কুড়ন জোয়ার্দ্দারের ছেলে আওলাদ জোয়ার্দ্দার (৭০) এবং ২০১৪ সালে সুবানের ছেলে আলী (৬৭), হযরত আলীর ছেলে মন্টু (৪৫), খোদা বক্সের ছেলে জামিউল (৪২) ও হান্নানের ছেলে রিয়াজ উদ্দিন (৭২) আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই গ্রামের মৃত শমসের আলীর ছেলে আজিজুল হক (৬০) ও মৃত আ. ছাত্তারের মেয়ে রেনু খাতুন (৪২) এ দুজন দীর্ঘদিন ধরে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছেন। আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে আজিজুলের ডান পা এবং রেনুর বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার নতিপোতা ইউনিয়নের বোয়ালমারী গ্রামের ৭ জন ও জুড়ানপুর ইউনিয়নের গোপিনাথপুর গ্রামের ৩ জন আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ২০০০ সালে উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামে এ রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং ২০০৭ সালে ওই গ্রামের রমজান আলীর ছেলে আ. হান্নান (৪৫) প্রথম মারা যান। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০০৯ সালে আমির হামজার ছেলে লিয়াকত আলী (৫৮), ২০১০ সালে একই পরিবারের খোকার ছেলে সদর আলী (৬০) ও সদর আলীর স্ত্রী অহরজান (৫৪), ২০১১ সালে ফকির মোহাম্মদের ছেলে তেতুল মিয়া (৬৩) এবং ২০১২ সালে আকমানের ছেলে মোস্তাকিম ( ৪১) ও মহির উদ্দিনের ছেলে আবেদ আলী (৭০) মারা যান। এছাড়া ২০০৭ সালে উপজেলার জুড়ানপুর ইউনিয়নের গোপিনাথপুর গ্রামে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০০৯ আকমানের ছেলে শেরেগুল (৩৭), ২০১০ সালে বানাত আলীর ছেলে সালে নাসির উদ্দিন (৪৫) এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালে মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফজিলা খাতুন (৪০) আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

এ বিষয়ে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডা. আবু হাসানুজ্জামান নূপুর বলেন, আমরা রোগ শনাক্তের পর থেকেই চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। নতুন করে কেউ আর্সেনিক আক্রান্ত হচ্ছে কি-না তা প্রতিমাসেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। বর্তমানে এ রোগটি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই কম-বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিমাসেই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮ সালে রোগীর সংখ্যা ছিলো ৩৩১ জন, ২০০৯ সালে ৪৪৬ জন, ২০১০ সালে ৪৪৮ জন, ২০১১ সালে ৪৬১ জন, ২০১২ সালে ৪৬২ জন, ২০১৩ সালে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে রোগীর সংখ্যা হয় ৭৬৭ জন। ২০১৪ সালে কিছু রোগী মারা যাওয়ায় রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫৯ জনে এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি শেষে আবারও রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে বর্তমানে উপজেলায় আর্সেনিক আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৭৬৯ জন। এরমধ্যে উপজেলার জুড়ানপুর ইউনিয়নে ৮৬ জন, নতিপোতা ইউনিয়নে ২১৫ জন, কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নে ৩৫ জন, কুড়ুলগাছি ইউনিয়নে ৩০ জন, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নে ২৮ জন, হাউলী ইউনিয়নে ৩০৪ জন, দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নে ৪৪ জন এবং দর্শনা পৌরসভায় ২৭ জন রোগী রয়েছে এবং তাদের নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, আমরা আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় নানাভাবে আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করে আসছি। এর মধ্যে ২০০৫ সালে উপজেলার বড়দুধপাতিলা গ্রামে ইউনিসেফের সহযোগিতায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আর্সেনিকমুক্ত পানির পাম্প নির্মাণের পর ওই পানির পাম্পটি গ্রামবাসীর নিকট হস্তান্তর করি। কিন্তু গ্রামের লোকজন ওই পাম্পটি চালু না রাখায় ওটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে ওই গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত আরো ৪টি রিং ওয়েল (কুয়া) ও ২টি আর্সেনিকমুক্ত অগভীর নলকূপ স্থাপন করি। একই বছর ইউনিসেফের সহযোগিতায় উপজেলার উজিরপুর গ্রামে প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই প্লান্ট নির্মাণ করি। এর আওতায় ৬৮০টি পরিবার আর্সেনিকমুক্ত পানি পাচ্ছেন। এছাড়া ফকিরপাড়া গ্রামে ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪টি রিং ওয়েল এবং মদনা গ্রামে একটি পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই প্লান্ট বসানো হয়। এ পাম্পের আওতায় ২৩৪টি পরিবার আর্সেনিকমুক্ত পানি পাচ্ছেন।