মহাসিন আলী/মাজেদুল হক মানিক: হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক সহিংস কর্মকাণ্ডের মূল টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে যানবাহন। অবরোধের নামে চোরাগোপ্তা হামলার মাশুল দিতে অনেক মোটর শ্রমিককর্মী এখন পঙ্গু। অপরদিকে টানা অবরোধে কাজ না থাকায় মেহেরপুর জেলার প্রায় ৫ হাজার মোটরশ্রমিক কর্মীর পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জ্বলছে যানবাহন; মরছে মানুষ। যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল উপেক্ষা করে মেহেরপুর সদর উপজেলার খোকশা গ্রামের ট্রাকচালক ফরজ আলী ট্রাক নিয়ে খুলনায় যাচ্ছিলেন সার আনতে। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের সদর উপজেলার রাজনগর নামক স্থানে পৌছুলে পিকেটারদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে তার বাম চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার পর তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসার পর আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেয়া হয় ভারতের একটি হাসপাতালে। প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচের পর চিকিৎসক তাকে জানান, তার বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি সারা জীবনে আর ওই চোখ দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে পারবেন না। সহায় সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা হলেও হারাতে হয়েছে চোখ। খরচের মধ্যে মাত্র ৮০ হাজার টাকা কোম্পানি প্রদান করেছে। তবুও থেমে নেই তার জীবন চলা। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় বর্তমানে একজন দক্ষ হেল্পার নিয়ে মাঝে মধ্যে ট্রাক চালিয়ে যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে পরিবারের ৬ জন সদস্যর কোনোমতে দিনতিপাত হচ্ছে। এতো গেলো ফরজ আলীর কথা।
অন্যদিকে টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে বর্তমানে মেহেরপুর জেলার প্রায় ৫ হাজার মোটরশ্রমিকরা এখন কর্মহীন। দিনমজুর এসব শ্রমিকের উপার্জনের একমাত্র পথ বন্ধ হওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।
বাসচালক নাসির উদ্দীন জানান, মোটরশ্রমিকরা অন্য কোনো কাজে অভ্যস্ত নয়। তাই গাড়ি চলাচল বন্ধ হলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। মোটরযানের কাজের ওপরেই একজন শ্রমিকের সুখ-দুঃখ নির্ভর করে। ২০১৩ সাল জুড়ে হরতাল-অবরোধে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই অবরোধের কবলে পড়ে তাদের সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে যানবাহন চালানোর জন্য জোর দেয়া হচ্ছে। জেলা থেকে দূরপাল্লায় চলা ৫০টি পরিবহনের মধ্যে মাত্র ৭টি পরিবহন গত কয়েক দিনে পুলিশি প্রহরায় চলাচল করছে। তবে কয়েকদিন আগের এক রাতে মেহেরপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ার পর চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে দু দফা ভাঙচুরের শিকার হয়েছে কয়েকটি পরিবহন। এতে পুলিশ প্রহরায় চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে অবরোধের প্রথম দিন থেকেই আন্তঃজেলা সকল রুটে লোকাল বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ধার-দেনা করে শ্রমিকরা কোনো রকমে সংসার খরচ মেটাচ্ছেন।
মোটরশ্রমিক কর্মীরা জানালেন, হরতাল কিংবা অবরোধের মধ্যে গাড়ি চালাতে গিয়ে কখনো যানবাহন ভাঙচুর আবার কখনো চালক, সুপারভাইজার ও হেলপারের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। ফলে হামলা আতঙ্কে গাড়ি চালাতে সাহস পাচ্ছেন না চালকরা। জীবনের ঝুঁকিতে কয়েকজন শ্রমিক যানবাহন চালালেও পরিবারের সদস্যরা থাকছেন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়।
মেহেরপুর জেলার সড়কগুলোতে হরতাল-অবরোধের কোনো সহিংসতা নেই। ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোনো জেলায় যেতে হলে প্রতিবেশী জেলা কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা কিংবা ঝিনাইদহ জেলার ওপর দিয়ে যেতে হয়। মূলত প্রতিবেশী জেলাগুলোর সড়কেই ঘটছে যানবাহন ভাঙচুর ও শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা।
বর্তমান সমস্যা সমাধানে দেশের প্রধান দু দলের নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ করেন শ্রমিকরা। সারাদেশের শ্রমিকদের বাঁচাতে রাজনীতিবিদদের প্রতি হরতাল অবরোধ বাদে বিকল্প কর্মসূচি দেয়ার আহ্বান জানান শ্রমিক নেতারা।