দু পক্ষই শক্ত অবস্থানে

স্টাফ রিপোর্টার: সরকার পক্ষ মনে করছে, প্রতিপক্ষ শক্তির সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারে। তাছাড়া নমনীয়তা দেখানো বা ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপিসহ ২০ দল মনে করছে, এবারের আন্দোলনে সরকার সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের ২৮তম দিন আজ। প্রায় প্রতিদিনই সহিংসতায় পুড়ছে যানবাহন, দগ্ধ হচ্ছে সাধারণ মানুষ, ঘটছে প্রাণহানি, ধ্বংস হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তবে এখন পর্যন্ত নিজ-নিজ অবস্থানে অনড় সরকার ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। সংলাপ-সমঝোতারও কোনো আলামত নেই। বরং উভয় পক্ষই প্রায় পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অবস্থানে অনড়। চলমান এই অবস্থানকে দুই পক্ষই দেখছে নিজেদের বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে। দু পক্ষেরই শঙ্কা- কোনো রকম ছাড় দিলে বা নমনীয়তা দেখালেই সামনে মহাবিপদ। পরিস্থিতি এমনদিকে গড়াচ্ছে যেন, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে বিলীন করতে মরিয়া

আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রগুলো জানায়, তারা মনে করছেন এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক একাধিক শক্তির বিরোধ চলছে না। এখানে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী শক্তির অবস্থান। বিপরীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই শক্তিটিকে তারা সন্ত্রাস ও উগ্র-জঙ্গিবাদের সহায়ক বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। তাদের মতে, প্রতিপক্ষ এই শক্তির সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারে। নমনীয়তা দেখানোর বা ছাড় দেয়ারও সুযোগ নেই। সরকার পক্ষ আরও মনে করে, বিপরীত শক্তির দাবি মেনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে হাঁটলে উত্থান ঘটতে পারে সন্ত্রাস ও উগ্র জঙ্গিবাদের। এতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের। যার কারণে প্রশাসনিকভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পক্ষেই এখনও অবস্থান সরকার ও আওয়ামী লীগের।

সরকার পক্ষ এমনটি দাবি করলেও বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের বক্তব্য একেবারেই ভিন্ন। তাদের ভাষ্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী, অগণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে প্রমাণে নানাভাবে চেষ্টা করছে সরকার। উদ্দেশ্য, সরকারের মেয়াদ পুরো পাঁচ বছর পূর্ণ করা। এই সময়ে নানা কৌশলে ২০ দলকে দুর্বল করার পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ জোটের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতাকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আইনিভাবে অযোগ্য করারও চেষ্টা করা হতে পারে। ফলে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনেও বর্তমান সরকারের সামনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে থাকবে না। যার কারণে চলমান আন্দোলনে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে নিয়েছে ২০ দল।

চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারপক্ষের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির চলমান কর্মসূচিকে তারা রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখছে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করে বিষয়টিকে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখে এটিকে প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলারই নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তাদের ভাষ্য, যৌথ অভিযানের মাধ্যমে সারাদেশে নাশকতার সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িতদের ধরপাকড় চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নাশকতামূলক কার্যক্রম থামানো গেলে ২০ দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি আপনাআপনিই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। ভীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে সাধারণ জনগণের নিত্যদিনের চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে।

এদিকে বিএনপিসহ ২০ দল মনে করছে, এবারের আন্দোলনে সরকার সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে। যে কারণে লাগাতার অবরোধ আর কতদিন চালিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বেগম খালেদা জিয়া অনড়। সমপ্রতি শিক্ষক নেতৃবৃন্দ এবং শুক্রবার রাতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৭ নেতা বেগম জিয়ার সাথে তার গুলশান অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি প্রায় অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকারকে আমরা এক বছর সুযোগ দিয়েছি। আলোচনার জন্য অব্যাহত আহবান জানিয়েছি। তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার। সরকারের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরবে না।

সূত্রমতে, ড. কামাল ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ ওই সাত নেতার সাথে আলাপকালে খালেদা জিয়া বলেছেন,  ডু অর ডাই। যা হওয়ার তাই হবে। জানা গেছে, বিএনপির মধ্যে যারা অবরোধ স্থগিত করে অন্য কর্মসূচির কথা বলার চেষ্টা করছেন, তারা খালেদা জিয়ার তোপের মুখে পড়ছেন, বিরাগভাজন হচ্ছেন।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সাথে কথা বলেও কর্মসূচি ঠিক করছেন। দুজনই অবরোধ অব্যাহত রেখে আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনড়। এ কারণে খালেদা জিয়া তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জানাজার দিনেও অবরোধ শিথিল করেননি। বরং কোকোর জানাজায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ বিএনপিকে উত্সাহিত করেছে। টানা অবরোধের মধ্যে হরতাল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে-এমন ধারণায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলায় হরতাল দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি স্বাভাবিক চরিত্র হারানোর কারণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে এই কর্মসূচি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দলের এক নেতা।

অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও গতকাল বলেছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের কোনো চিন্তা-ভাবনা সরকারের নেই। বিষয়টি আদালতের ওপর ছেড়ে দেবে সরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে নতুন আলোচনার খোরাক যুগিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের দুই সদস্য আমির হোসেন আমু ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তারা দু’জনেই বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনে সাংবিধানিক বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ‘দেশে জরুরি অবস্থা আসতে পারে’- এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে।

অন্যদিকে সরকার-আওয়ামী লীগ ও ২০ দলের অনড় অবস্থানের মধ্যে নতুন ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারের দু মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ওবায়দুল কাদের। শনিবার তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেছেন, বিএনপি যদি তাদের দাবি ঠিক করে তাহলে সংলাপ হতে পারে। তবে দাবি যদি হয় সরকারের পতন-তাহলে সংলাপ হবে না। একইদিন সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থে সরকার নিশ্চয়ই অনড় থাকবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও ইত্তেফাককে বলেন ‘এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ দুই দলের সমঝোতা।’